অভাবে ডাক্তার না দেখিয়ে ছেলেদের নাপা কিনে দেন মা!
ইসমাইল হোসেন ও লিমা বেগম দম্পতির প্রথম সন্তান জন্মের তিন দিনের মাথায় মারা যায়। সেই সন্তান হারানোর বেদনা ভুলিয়ে রেখেছিল পরবর্তী দুই সন্তান ইয়াছিন (৭) ও মোরসালিন (৫)। কিন্তু, শেষ রক্ষা হলো না। একসঙ্গে দুই সন্তানকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় এই দম্পতি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। তিনি সিলেটের একটি ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর স্ত্রী লিমা বেগম কাজ করেন আশুগঞ্জের একটি চালকলে।
অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। টাকার অভাবে জ্বরে আক্রান্ত দুই শিশু সন্তানকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি তাঁরা। বাড়ির পাশের একটি ফার্মেসি থেকে নাপা সিরাপ এনে খাওয়ান। সেই সিরাপ খাওয়ানোর পর পরই অসুস্থ হয়ে পড়ে শিশু ইয়াছিন ও মোরসালিন। পরে তাদের দুজনেরই মৃত্যু হয়।
দুই শিশুর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিনেও জ্বর না কমায় গত ১০ মার্চ বিকেলে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাকে বলে ছোট ছেলে মোরসালিন। মা লিমা বেগম তখন তাকে আশ্বাস দেন, চালকল থেকে কাজের টাকা পাওয়ার পর ভালো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন।
পরে লিমার কাছ থেকে ৩০ টাকা নিয়ে দুই শিশুর দাদি লিলুফা বেগম পাশের বাজারের মা ফার্মেসি থেকে এক বোতল নাপা সিরাপ কিনে আনেন। এরপর সেই সিরাপ আধা চামচ করে ইয়াছিন ও মোরসালিনকে খাওয়ানো হয়। এর কিছুক্ষণ পরই শিশুদের মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করে।
কাঁদতে কাঁদতে দুই শিশুর মা লিমা বেগম এ প্রতিবেদককে বলেন, “ওই দিন আমার ছেলে বলল, ‘আম্মা আমাকে ভালো ডাক্তারের কাছে নিবা না?’ আমি তখন বলেছি, ভালো ডাক্তারের কাছে এখন নিতে পারব না, আমার কাছে এখন টাকা নেই। আপাতত দুই ভাইকে একটা নাপা সিরাপ এনে খাওয়াই। সিরাপ খাওয়ানোর ১৫-২০ মিনিট পরই দুজনের মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে ডাক্তাররা অক্সিজেন দিয়ে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন।”
লিমা বেগম অভিযোগ করে বলেন, “সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বলেন, ‘আপনার ছেলেরা সম্পূর্ণ সুস্থ। বাড়িতে নিয়ে টক আর পানি খাওয়ান বেশি করে।’ কিন্তু, বাড়িতে আনার পথেই আমার এক ছেলে মারা যায়। বাড়িতে এসে আরেকজনের মৃত্যু হয়।”
মৃত দুই শিশুর মা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ডাক্তাররা তাহলে কী দেখল? আমার ছেলেগুলোকে একটু চিকিৎসাও তারা দিল না কেন?’
এদিকে, নাপা সিরাপ খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পর থেকে সপরিবারে গা ঢাকা দিয়েছেন দুর্গাপুর গ্রামের সড়ক বাজারের মা ফার্মেসির মালিক মো. মঈনউদ্দিন।
গতকাল রোববার দুপুরে দুর্গাপুরের পাশের তাজপুর গ্রামে মঈনউদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি।
ফার্মেসি পরিচালনার জন্য ঔষধ প্রশাসন থেকে ড্রাগ লাইসেন্স নেওয়ার পাশাপাশি ন্যূনতম সি-গ্রেডের ফার্মাসিস্ট কোর্স করা একজন ফার্মাসিস্টের প্রয়োজন হয়। তবে মা ফার্মেসিতে এগুলো ছিল কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ঔষধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হোসাইন মো. ইমরান বলেন, “আশুগঞ্জ উপজেলায় ‘মা ফার্মেসি’ নামে ১৭টি লাইসেন্স আছে। এখন এর মধ্যে দুর্গাপুরের মা ফার্মেসির লাইসেন্স আছে কি না, সেটি স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। কারণ মালিককে আমরা পাইনি। এজন্য তাঁর কাগজপত্র আছে কি না, সেটি যাচাই করতে পারছি না। এ ছাড়া কোনো ফার্মাসিস্ট ছিল কি না, সেটিও জানা যাচ্ছে না। তার সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত তার ফার্মেসির বৈধতা সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।”
বর্তমানে দুর্গাপুর গ্রামের সড়ক বাজারে নয়টি ফার্মেসি আছে। এর মধ্যে কেবল তিনটি ফার্মেসি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ওষুধের অর্ডার দেন। বাকিরা কিশোরগঞ্জের ভৈরব এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাইকারি ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কেনেন বলে জানা গেছে।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের আশুগঞ্জ উপজেলার দায়িত্ব পালনকারী সিনিয়র মেডিকেল প্রমোশন এক্সিকিউটিভ মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সব ফার্মেসির সঙ্গে আমাদের ব্যবসা নেই। আলোচিত এই মা ফার্মেসিও আমাদের কাছ থেকে ওষুধ নেয় না। আমাদের কাছ থেকে মাত্র তিনটি ফার্মেসি ওষুধ নেয়।’
এদিকে আশুগঞ্জ উপজেলায় ওষুধ খেয়ে দুই শিশুর মারা যাওয়ার আলোচিত ঘটনায় গতকাল দুপুরে ঔষধ প্রশাসনের তদন্ত কমিটি উপজেলার দুর্গাপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে মুরসালিন ও ইয়াসিনের মা-বাবা, দাদি এবং চাচার সাক্ষ্য নেয়।
স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে, তদন্ত কমিটির প্রধান ডা. আকিব হোসেন সাংবাদিকদের জানান, যে সিরাপটি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, সেটি পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। একই ওষুধের অন্যান্য ব্যাচের ওষুধ সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
শিশুদের স্বজনরা জানিয়েছেন, ওষুধ খাওয়ানোর পরই তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ওষুধটিতে কী এমন উপাদান ছিল- যেটি খাওয়ার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে রিঅ্যাকশন করল। এটি আসলে রহস্যজনক বিষয়। এই রহস্য উদঘাটন করতে হয়তো সময় লাগবে ।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল এবং আশুগঞ্জে দুর্গাপুর গ্রামের আসে রাত ৮টায়। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মহিউদ্দিনকে প্রধান করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গঠিত কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটির বাকি দুই সদস্য হলেন, কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. মীর মোবারক হোসাইন ও ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. রফিক-উস-ছালেহীন। তাঁরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গঠিত কমিটির প্রধান কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মহিউদ্দিন তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।