অভাব থামাতে পারেনি বইপ্রেমী আসাদের ছুটে চলা

Looks like you've blocked notifications!
নিজের গড়া পাঠাগারের সামনে আসাদ। ছবি : আতিফ আসাদ

ছোটবেলায় বিজ্ঞানী নিউটন বেশ শান্ত ও চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন। এতে তাঁর পরিবার ধরে নিল, এই বোকাসোকা ছেলেটাকে দিয়ে ভালো কিছু হবে না! নিউটনের পরিবার তাঁকে স্কুল ছাড়িয়ে চাষের কাজে জুড়ে দিলেন। কিন্তু কাজ পালিয়ে নিউটন হঠাৎ কোথায় যেন উধাও হয়ে যেতেন। খবর নিয়ে জানা গেল, নিউটন বই পড়তে কোনো এক পরিচিতজনের বাড়ি যেতেন। সেখানে একটি সুন্দর পাঠাগার ছিল। ওই পাঠাগারে ঢুকেই নিউটন বইয়ের মধ্যে হারিয়ে যেতেন। এমনকি বাড়ি ফেরার কথা ভুলে যেতেন। এ ঘটনা শুনে নিউটনের পরিবার তাঁকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।

নিউটনের মতো বইপোকা আমাদের দেশেও আছে। যারা পড়তে ভালোবাসে, অন্যকে বই পড়ায় উৎসাহ দিতে ভালোবাসে। এমন এক তরুণ শেখ মুহাম্মদ আতিফ আসাদ। বাড়ি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের হাসড়া মাজালিয়া গ্রামে। নিজের পড়ার ইচ্ছে ও অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে এ তরুণ নিজের ঘরের বারান্দায় গড়ে তুলেছেন একটি পাঠাগার। তাঁর পাঠাগারের নাম ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’। শুধু পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই থেমে নেই তাঁর প্রচেষ্টা। পাঠকের সুবিধার্থে সাইকেল চালিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দেন এই তরুণ। বিনিময়ে নেন না কোনো পারিশ্রমিক।

আর্থিক সক্ষমতা বা পাঠাগার করার পর্যাপ্ত স্থানও ছিল না। শুধু মনের জোরেই আসাদের স্বপ্নের নির্মাণ পাঠাগারটি। মিলন স্মৃতি পাঠাগারের সূচনা হয় ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতেই এ পাঠাগারের যাত্রা শুরু। নিজ ঘরের বারান্দায় পাটকাঠির বেড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে এই পাঠাগার। ছোট্ট এ পাঠাগারটির যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র ২০টি বই নিয়ে। পরে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ পাঠাগারে বই-সহায়তা দেয়। বর্তমানে প্রায় দুই হাজার ৫০০ বই রয়েছে এ পাঠাগারে।

আসাদের পাঠাগার। ছবি : আতিফ আসাদ

পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পর থেকে এলাকার সবাই বিনাখরচে বই পড়ছেন। প্রতিনিয়ত আসাদের পাঠাগারে পাঠক বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁর পাঠাগারে পড়ার জায়গা কম থাকায় গ্রামের মানুষ নিজেদের বাড়িতে বই নিয়ে পড়েন। সপ্তাহ শেষে আবার সেই বই ফেরত আসে পাঠাগারে। বই আদান-প্রদানের এই পুরো কর্মযজ্ঞে আসাদের একমাত্র সঙ্গী তাঁর সাইকেল। সাইকেল নিয়ে পার্শ্ববর্তী ১২-১৫ কিলোমিটার দূরত্বে পাঠকের কাছে প্রতিনিয়ত পৌঁছে যান আসাদ। কিছুদিন আগেও পুরোনো একটি সাইকেলে ঘুরে ঘুরে বই দিতেন। এমনটা দেখে শেখ সিরাজ নামের একজন প্রবাসী তাঁকে একটা নতুন সাইকেল উপহার দেন।

আসাদ জামালপুর সরকারি কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে পড়ছেন অনার্স প্রথম বর্ষে। লেখাপড়ার পাশাপাশি এখন একাই পাঠাগার সামলাচ্ছেন। এই বইপোকার পড়ার নেশা সেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে। নিজে যখন বই পড়তেন, তখন অনুধাবন করতেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মানুষ বই পড়তে চান। ইচ্ছা থাকলেও টাকার অভাবে বই কিনতে পারেন না তাঁরা। এমন চিন্তা থেকেই আসাদের পাঠাগার তৈরির ইচ্ছার সূত্রপাত। পাঠাগার করার ব্যাপারে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করেতেই হাসির পাত্রে পরিণত হন আসাদ। পরে বড় ভাইয়ের পরামর্শে ঘরের বারান্দায় পাঠাগার করার সিদ্ধান্ত হয়।

বাবা আফজাল হোসেন এবং মা জয়নব বিবির ছোট ছেলে আসাদ। কখনও কাঠমিস্ত্রি বা রাজমিস্ত্রি, কখনও দিনমজুর, কখনও কৃষিকাজ করে পরিবার চালাতেন আসাদের বাবা আফজাল হোসেন। এখন বয়সের ভারে কাজ থেকে অবসরে গিয়েছেন। বাবা, মা, মৃত বড় ভাইয়ের স্ত্রী ও দুই মেয়ে, মেজ ভাই ও তাঁর স্ত্রীর মেয়ে এবং আসাদসহ মোট নয় সদস্যের পরিবার। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর রড-সিমেন্ট-টিনের দোকানে কাজ করে পরিবার চালাচ্ছেন আসাদের মেজ ভাই আল আমিন। পাশাপাশি সুযোগ পেলে যেকোনো কাজ করে কিছু টাকা আয়ের চেষ্টা করেন আসাদ। খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার জন্য মহল্লার দোকান থেকে বাকি নিতে হয়। সেই টাকা ধীরে ধীরে পরিশোধ করতে হয়। অভাবী পরিবারে জন্ম নিলেও আসাদের লেখাপড়ার ইচ্ছা আকাশচুম্বী। কিন্তু পড়ালেখার খরচ চালানোর সার্মথ্য কই? তাই নিজের লেখাপড়া চালাতে মাঝেমধ্যেই দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন আসাদ।  ইটভাটায় কাজ, কাঠের কাজ, ধান কাটার কাজ করতে হয়। এত কষ্টের পরেও দমে যাননি এই তরুণ।

পাঠাগারের নামকরণ নিয়ে জানতে চাইলে আতিফ বলেন, ‘পাঠাগার করার ইচ্ছাকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন জানিয়েছেন আমার বড় ভাই রবিউল ইসলাম মিলন। ঘরের বারান্দায় পাঠাগার নির্মাণের ব্যাপারে প্রথম পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনিই। এরপর জমি-সংক্রান্ত বিরোধে ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমার ভাই প্রভাবশালীদের হাতে খুন হন। এরপর তাঁর নামেই আবার নতুন উদ্যমে শুরু করলাম। আমার ভাই যেহেতু সব সময় পাঠাগারের বিষয়ে অনুপ্রেরণা দিতেন, উৎসাহ যোগাতেন, তাই তাঁর নামেই পাঠাগারের নাম দিলাম মিলন স্মৃতি পাঠাগার।’

বাবা-মায়ের সঙ্গে আসাদ। ছবি : আতিফ আসাদ

পাঠাগার স্থাপন বিষয়ে আসাদ বলেন, ‘ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজের পড়তে না পারার বিষয়টি আমাকে দারুণ পোড়ায়। আমার মতো গ্রামের অন্য তরুণদের কথাও চিন্তা করলাম। ওদেরও তো জ্ঞান অর্জন করা দরকার। সেই ভাবনা থেকেই আমার পাঠাগার করার চিন্তার উদ্ভব।’

পাঠাগার নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? জানতে চাইলে আসাদ বলেন, ‘বই পড়া আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে আমার উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামে নতুন নতুন পাঠাগার তৈরি করা। সবাই যেন বই পড়তে পারে। ছেলেমেয়েরা অবসর সময়ে আগের মতো যেন বই পড়ায় ফিরতে পারে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই। ছেলেমেয়েদের বই পড়ায় আগ্রহী করতে ছুটতে চাই গ্রাম থেকে গ্রামে।’

গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কেমন সমর্থন পাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে আসাদ বলেন, ‘গ্রামের মানুষ প্রথমে বুঝত না, উপহাস করত। হাসাহাসি করত। বলত পাগল হয়েছে। এখন কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। অনেকে পাঠাগারের উপকারিতা বুঝতে পারছেন।’

সুন্দর একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেন আসাদ। তারুণ্যকে কাজে লাগিয়ে স্বপ্ন বোনেন হৃদয়ে। তাঁর স্বপ্ন, প্রত্যেক গ্রামে একটি করে পাঠাগার হবে। লাখ লাখ পাঠাগার হবে বাংলাদেশে। গ্রামের সব মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে বই পড়বে। মানুষ বইয়ের আলোয় আলোকিত হবে। আসাদের ভাইয়ের মতো কোনো ভাই আর খুন হবে না। মানুষ আইনের আশ্রয় পাবে। দ্রুততম সময়ে সব অপরাধের সঠিক বিচার হবে। আসাদের ধারণা, এসব সম্ভব করতে পারে কেবল মানুষের সঠিক মানসিকতা। আর সেই মানসিকতা গড়ার কেন্দ্রবিন্দু বই। তাই তো মানুষের কাছে বই নিয়ে তাঁর অবিরাম ছুটে চলা।