আউয়াল কমিশনের বছরটি কেমন গেল?

Looks like you've blocked notifications!

কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) দায়িত্ব গ্রহণ করে বিদায়ী বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি। তারপর থেকে পুরো সময় কেটেছে নানা রেকর্ড, আর আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে। আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে ডাকা সংলাপকে অনেকে ইতিবাচক দেখলেও সাড়া দেয়নি বিএনপি। আলোচনায় ছিল সিইসির তলোয়ার-রাইফেল বিতর্ক ও গাইবান্ধার উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণা।

এদিকে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচনি এলাকা ছাড়তে দেওয়া নির্দেশকে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের বুড়ো আঙুল ইসিকে করে প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও ঝিনাইদহ পৌর নির্বাচনে অপরাধে লিপ্ত নৌকা প্রতীকের মেয়র পদপ্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল ও গাইবান্ধার উপনির্বাচন বন্ধ আউয়াল কমিশনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তোলে।

অন্যদিকে, নির্বাচনে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারে আশার আলো মিললেও সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্প নেওয়ায় বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। যদিও ইসির ধারণা, সংসদ নির্বাচনে সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের সুযোগ হবে না।

বিএনপি সংলাপে সাড়া দেয়নি

দায়িত্ব গ্রহণ করেই হাবিবুল আউয়াল কমিশন রাজনীতিক, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৭ থেকে ৩১ জুলাই রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানায় সংস্থাটি। এতে বিএনপিসহ নয়টি দল ইসির ডাকে সাড়া দেয়নি।

যেসব দল সংলাপে অংশ নিয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি করে। অনেকেই আপত্তি তোলে ইভিএম নিয়ে। কোনো কোনো দল সংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে নির্বাচনের যুক্তি তুলে ধরেন। তবে নির্বাচন কমিশন সংবিধানের মধ্যে থেকেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়, সেই যুক্তি তুলে ধরে।

সাংবিধানিক বিষয়গুলো মীমাংসার দায়িত্ব তাদের নয় বলে জানায়। একইসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় ইভিএমের ব্যবহার বাড়ানোর। বিষয়টিকে অনেকেই লোক দেখানো সংলাপ বলেও মন্তব্য করেন।  

সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ

আউয়াল কমিশন কেবল সংলাপই দ্রুত করেননি, তার ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর আগে তৈরি করে রোডম্যাপ। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তাদের সব উদ্যোগ, পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। কখন কোন কাজ কমিশন করবে, তা জানাতে সাধারণের জন্য রোডম্যাপও প্রকাশ করে।

তলোয়ার-রাইফেল বিতর্ক

ববি হাজ্জাজের দল এনডিএমের সঙ্গে সংলাপে বসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল মন্তব্য করেন, ‘আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করব?’ এই বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়। ব্যাপক সমালোচনার তোপে পরবর্তীতে অবশ্য সিইসি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান।

ইসির নির্দেশ মানেননি সংসদ সদস্য

কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে কুসিক নির্বাচনি এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিলে তিনি ইসিকে বুড়ো আঙুল দেখান। একইসঙ্গে ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের শরণাপন্ন হন। একজন এমপিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ ইসি কী করে ৩০০ এমপিকে সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ন্ত্রণ করবে—এই প্রশ্ন যখন সামনে আসে, ঠিক তখনই পুরো ইউটার্ন নেন সিইসি। তিনি বলেন, ‘বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেননি, তাকে অনুরোধ করেছেন। ভোটের এলাকায় কারও বাড়ি হলে বাড়িতে থাকতে বাধা নেই।’ পরে এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি। 

সিসি ক্যামেরায় ভোট পর্যবেক্ষণ

কুসিক নির্বাচনের মধ্য দিয়েই প্রতিটি ভোটকক্ষ পর্যবেক্ষণের আওতায় আনে ইসি। এতে ভোটকেন্দ্রের বাইরে ছিল শান্ত, ভোটগ্রহণ হয় সুশৃঙ্খলভাবে। কমিশনের এই উদ্যোগকে অনেকেই সাধুবাদ জানান।

১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচনে অতীতের সব ইতিহাস ছাপিয়ে নজির স্থাপন করে আউয়াল কমিশন। সিসি ক্যামেরায় ভোট পর্যবেক্ষণ করে ৫০টি কেন্দ্রে অনিয়মের চিত্র দেখতে পেয়ে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এদিকে, রিটার্নিং কর্মকর্তাও একটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দেন। পরে নির্বাচনের কোনো যৌক্তিকতা না থাকায় পুরো নির্বাচনের ভোটগ্রহণ বাতিল করে দেয় ইসি। একইসঙ্গে অনিয়মে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। যার ভিত্তিতে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ ১৩৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির সিদ্ধান্ত দেয় ইসি। দেশের ইতিহাসে কোনো আসনের ভোট অনিয়মের কারণে বন্ধ করে দেওয়া এটি একটি নজির। এ ছাড়া এতো কর্মকর্তাকে শাস্তি আওতায় আনার সিদ্ধান্তও রেকর্ড। 

নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল

গত ২ জুন ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনে নির্বাচনি অপরাধে লিপ্ত থাকায় নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মো. আব্দুল খালেকের প্রার্থিতা বাতিল করে ইসি। বিষয়টি সকলের মাঝেই আউয়াল কমিশনের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে তোলে। তবে, আদালত থেকে রায় নিয়ে পরবর্তীতে প্রার্থিতা ফিরে পান আব্দুল খালেক।

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন

সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মতামত এবং বিএনপিসহ অন্যান্য দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও আট হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার নতুন ইভিএম প্রকল্প হাতে নেয় ইসি। প্রকল্প প্রস্তাবটি সরকারের তরফ থেকে অনুমোদন হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ইসির পরিকল্পনা হচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে আরও দুই লাখ ইভিএম ক্রয় করে ১৫০ আসনে এই ভোটযন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করার। 

দেশের সেরা প্রযুক্তিবিদরা এই মেশিনকে নির্ভরযোগ্য বললেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এর মাধ্যমে ভোট কারচুপি করা সম্ভব। এখন যুক্তি হিসেবে তারা গাইবান্ধার নির্বাচনকে সামনে আনছেন। কেন্দ্রের বাইরে কোনো হইচই না থাকলেও গোপনকক্ষে দুর্বৃত্তরা অন্য জনের ভোট নিয়ে নিচ্ছেন।

যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, এই দুর্বৃত্ত ঠেকানো একটি চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ তারা একা মোকাবিলা করতে পারবে না।

সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, দলগুলোকে সমানভাবে কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নিয়ে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে।

ভিন্ন নামে নিবন্ধন চায় জামায়েত ইসলামী

নিবন্ধন হারিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য জামায়াতে ইসলামী-সংশ্লিষ্ট একটি অংশ নতুন নামে নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন করেছে। নাম দিয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি-বিডিপি। এর আগে জামায়াত থেকে বেরিয়ে আসা একটি অংশ এবি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি) নামে দল গঠন করে নিবন্ধনের আবেদন করে রেখেছে ইসিতে।

৫০ হাজার পৃষ্ঠার প্রয়োজনীয় তথ্যসহ নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি-বিডিপি। দলটির সভাপতি হলেন অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চান ও জেনারেল সেক্রেটারি মুহা. নিজামুল হক। তবে, এ নিয়ে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে ঘোর আপত্তি তোলা হয়।