আন্দোলন আর বিতর্কে কাটল বিএনপির বছর
দেশে রাজনীতির মাঠে অন্যতম বিরোধীদল বিএনপি। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি দলীয় চেয়ারপারসনের অসুস্থতা, তাঁর স্থায়ী মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে আন্দোলন, দলের নেতাদের বিতর্কিত মন্তব্যসহ বিভিন্ন ইস্যুতেই ২০২১ সালে সরব ছিল।
খালেদা জিয়ার করোনা আক্রান্ত হওয়া, বিদেশে নেওয়ার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন-সমাবেশ, নেতাদের সঙ্গে তারেক রহমানের সিরিজ বৈঠক, মহানগর উত্তর-দক্ষিণের কমিটি, বিজয় শোভাযাত্রা, বরিশাল থেকে মুজিবুর রহমান সরোয়ার, খুলনা থেকে নজরুল ইসলাম মঞ্জু এবং রাজশাহী থেকে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে দল থেকে অব্যাহতি, প্রেসক্লাবে জামায়াত নেতার সঙ্গে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাকবিতণ্ডা, ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে দূরত্ব, কয়েকটি দলের জোট ত্যাগ, জিয়াউর রহমানের সমাধি সৌধ ইস্যু, জিয়া উদ্যানে পুলিশের সঙ্গে মহানগর উত্তর কমিটির সংঘর্ষ, চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ বিএনপি, শুল্ক ফাঁকির মামলায় এমপি হারুণ, ইলিয়াস আলীকে নিয়ে মির্জা আব্বাসের বক্তব্য, ব্যারিস্টার মওদুদের ইন্তেকাল, খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামালকে অব্যাহতি, করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে বিভিন্ন নেতার নেতিবাচক বক্তব্য- এসবই ছিল বছরজুড়ে বিএনপির রাজনীতির উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
যদিও ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের নেতারা বলেছিলেন, ২০২১ সালই হবে বর্তমান সরকারের শেষ বছর। এ বছরেই সরকারের পতন ঘটাবেন তারা। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই করতে পারেনি দলটি। এমনকি খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর দাবি আদায়েও ব্যর্থ হয়েছে।
করোনায় আক্রান্ত খালেদা জিয়া
চলতি বছরের ১১ এপ্রিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ ২৭ দিন পর ৯ মে করোনা থেকে সুস্থ হন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ১১ এপ্রিল রাতে খালেদা জিয়ার করোনা পরীক্ষার নমুনা দেওয়া হলে ওইদিন রাতে ফলাফল আসে তিনি পজেটিভ। এর ১৪ দিন পর ২৫ এপ্রিল ফের করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা নেওয়া হলেও পরীক্ষায় তাঁর শরীরে করোনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সর্বশেষ ৯ মে রাতে তৃতীয় পরীক্ষায় খালেদা জিয়া করোনা নেগেটিভ হন।
দ্বিতীয় দফায় সিসিইউতে খালেদা জিয়া
প্রথম দফায় প্রায় দুই মাসের মতো সিসিইউতে থাকার পর ১৩ নভেম্বর ফের এভার কেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে নেওয়া হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। সেই থেকে তিনি এখনও সিসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। রক্তের হিমোগ্লোবিন অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া, লিভার সিরোসিস, পরিপাকতন্ত্র থেকে রক্ত যাওয়া, রক্ত বমিসহ কিছু জটিলতার কারণে বর্তমানে তিনি সিসিইউতে আছেন। এভার কেয়ারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। হাসপাতালে ভর্তির আগে ১২ নভেম্বর থেকে ডায়বেটিস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় খালেদা জিয়ার। রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে সাতে চলে আসে, কিডনির ক্রিয়েটিনিন বর্ডার লাইন ক্রস করে।
বিদেশে নেওয়ার আবেদন নাকচ
চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে যেতে সরকারের কাছে আবেদন করেন ছোট ভাই শামীম ঈস্কান্দার, বোন সেলিনা ইসলাম। কিন্তু আইনের বিধান না থাকার কথা বলে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার আবেদন নাকচ করে দেন আইনমন্ত্রী।
খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।
বিএনপির সিরিজ বৈঠক
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির অবস্থান, কর্মকৌশল ঠিক করতে টানা তিনদিন দলের নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সিরিজ বৈঠক করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রথম দিনে তিনি বৈঠক করেন দলের ভাইস-চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে। দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সম্পাদক ও সহসম্পাদক এবং তৃতীয় দিনের বৈঠকে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন। সিরিজ বৈঠকে বিএনপির নেতারা আগামী নির্বাচন, খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি ও আন্দোলন ইস্যু এবং জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেওয়ার জোর দাবি জানান।
নড়াইলে তারেক রহমানের সাজা
আগেই তিন মামলায় দণ্ডিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে মানহানিকর বক্তব্যের অভিযোগে করা মামলায় তাঁকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। নড়াইলের জেলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-২ আদালতের বিচারক জামাতুল মোর্শেদা তারেক রহমানকে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
ইলিয়াস আলীকে নিয়ে মির্জা আব্বাসের বক্তব্য
‘সরকার নয়, দলের বদমাইশগুলো বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী গুমের নেপথ্যে রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। সবাই তাদের জানে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের এমন বিস্ফোরক তথ্য দেওয়ার পর দলের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। সরকার ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে এতদিন ধরে দলটির পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ থাকলেও মির্জা আব্বাসের ওই বক্তব্যে নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক শুরু হয়। দলের মধ্যে অনেকটা চাপে পড়েন প্রভাবশালী এ নেতা। যেখানে ইলিয়াস আলী ইস্যুতে সরকারকে দায়ী করা হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে, সেখানে মির্জা আব্বাস কেন সেটা বিএনপির ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন- এটা নিয়ে নেতাকর্মীদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়।
ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে বিতণ্ডায় ছাত্রদলনেতা
রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে মন্তব্য করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিতণ্ডায় জড়িয়ে যান ছাত্রদলের সহসভাপতি ওমর ফারুক কায়সার। অনুষ্ঠানে ডা. জাফরুল্লাহ বলেছিলেন, ‘তারা (সরকার) যেভাবে তাঁকে (খালেদা জিয়া) জীবিত থাকতে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে শুরু করেছে, সেটা হয়তো বিএনপির লোকেরা উপলব্ধি করে না। তাই তারা (বিএনপি) যদি তাঁর মুক্তি চায় তবে তারেক দুই বছর চুপচাপ বসে থাক। বিলেতে লেখাপড়ায় যুক্ত হয়ে যাও।’
জাফরুল্লাহর বক্তব্য চলাকালে সভাস্থলে নেতাকর্মীসহ হাজির হন ছাত্রদলের সহসভাপতি ওমর ফারুক কায়সার। তিনি ডা. জাফরুল্লাহকে উদ্দেশ করে প্রথমে সালাম দেন। তারপর উচ্চস্বরে বলতে শুরু করেন, ‘আমাদের নেতা (তারেক রহমান) সম্পর্কে আপনি বলছেন কেন, তাঁকে নিয়ে বলার আপনি কে?’ জবাবে জাফরুল্লাহ বলেন, ‘না, না আপনার নেতা সম্পর্কে বলছি না। কথা শুনে তবেই বলেন। আপনাদের ভালোর জন্যই বলছি। আপনারা নিজেদের ভালো বোঝেন না।’ তখন ওমর ফারুক কায়সার বলেন, ‘সব বুঝি। আমরা অবশ্যই বুঝি। আমাদের নেতাকে ছোট করছেন।’ ফের ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আমি ছোট করছি না, আপনাদের নেতাকে বড় করছি।’
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মৃত্যু
এ বছরই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ইন্তেকাল করেছেন। ১৬ মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ১ ফেব্রুয়ারি সস্ত্রীক সিঙ্গাপুরে যান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এর আগে থেকেই তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।
মারুফ কামাল খান সোহেলকে অব্যাহতি
চলতি বছরের ৫ এপ্রিল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেলকে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০১৮ সাল থেকেই মারুফ কামাল খান নিষ্ক্রিয়। তিনি তাঁর কর্মস্থলে আসছেন না। দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও গাফিলতি করেছেন। এ জন্য স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তাঁকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ডা. মুরাদ ইস্যুতে তোপের মুখে মির্জা ফখরুল
নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য করে পদ হারানো তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান ছাত্রজীবনে ছাত্রদল করতেন- এমন কথা বলে তোপের মুখে পড়েন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসসলাম আলমগীর। ডা. মুরাদ ছাত্রজীবনে ছাত্রদল নেতা ছিলেন বলার পর যুবদল নেতা গোলাম মওলা শাহীন এর প্রতিবাদ জানান। এরপর মির্জা ফখরুল তাঁকে উদ্দেশ করে ধমক দেন। বলতে থাকেন, যুবদল নেতা জানেন না, তিনিই জানেন। মির্জা ফখরুল বারবার যুবদল নেতাকে তাঁর কাছে যেতে বলতে থাকেন এবং তিনি অন্যদের কাছে তাঁর পরিচয় জানতে চান।