পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক

ইউএনও’র সিল-সই জাল করে ৭০০ জনকে ঋণ, খেলাপি ৯ কোটি টাকা!

Looks like you've blocked notifications!
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। ফাইল ছবি

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাঠ সহকারীদের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ৭০০ ব্যক্তিকে উদ্যোক্তা ঋণ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত চার বছরে নামে-বেনামে গ্রাহকদের অন্তত পাঁচ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ অডিটকালে বিষয়টি নজরে আসে। ব্যাংকের ১৬ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে প্রায় ৯ কোটি টাকাই খেলাপি বলে জানা গেছে। 

এদিকে, কম্পিউটার অপারেটর ও মাঠ সহকারীরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান কমলনগরে যোগদানের দুই বছর আগেই তাঁর সই-সিল ব্যবহার করে জালিয়াতি করেছেন। বিষয়টি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ সোলায়মান লিখিতভাবে ইউএনওকে জানিয়েছেন। এটি তদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন ইউএনও।

অন্যদিকে, মাঠ সহকারীদের খামখেয়ালি ও অনিয়মের কারণে আট কোটি ৮৩ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। সাবেক ব্যবস্থাপক সাব্বির আহমেদ ও কম্পিউটার অপারেটর ইব্রাহিম খলিল উল্যার যোগসাজসে বিতরণ করা ঋণ খেলাপি গ্রাহকদের বেশির ভাগই মাঠ সহকারীদের আত্মীয়-স্বজন, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। এর মধ্যে তাঁরা কিছু গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করেছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে এবং অডিট চলাকালে তড়িঘড়ি করে ৪৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা মাঠ সহকারীরা জমা দেন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ গ্রাহকেরা।

স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাজিরহাট ইউনিয়নের মাঠ সহকারী ইশতিয়াক হোসেন, চরমার্টিনের আবুল কালাম, চর লরেন্সের মাইন উদ্দিন, চরকালকিনির কামাল উদ্দিন, পাটারির হাটের আবদুল খালেক সুমন, চরকাদিরার ইসমাইল হোসেন ও শামিম হাসান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া ঋণ অনুমোদন করানোর অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা সিন্ডিকেট করে নামমাত্র কিছু (৫০-৫০০) টাকা নিজেরাই নামে-বেনামে সঞ্চয় জমা করে প্রথমে ভুয়া সমিতি গঠন করে। এ ক্ষেত্রে নদীভাঙা মানুষের নাম-পরিচয় ব্যবহার করা হলেও তাঁরা জানেনই না। পরবর্তীকালে ওইসব সমিতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা ঋণ উত্তোলন করা হয়। একেকটি সমিতির গ্রাহক থাকে ২০ থেকে ৬০ জন। একেকজনকে ২০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়। তবে, এখানে সর্বোচ্চ এক লাখ ৫০ হাজার পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মাঠ সহকারীদের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা ঋণের টাকা জমা না দিয়ে পকেট ভারী করার অন্তত ১৫টি অভিযোগ এসেছে প্রতিবেদকের কাছে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা জানান, কমলনগরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর যোগদান করেন। অথচ ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর, ১২ ডিসেম্বর ও ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বরসহ বিভিন্নসময়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ ফরমে কামরুজ্জামানের সই ও সিল ব্যবহার করা হয়। তাঁর সই জাল করেই চরকালকিনির খানপাড়া সমিতির মো. ইউসুফ ৫০ হাজার টাকা, চরলরেন্সের আলতাফ হোসেন ৫০ হাজার টাকা ও তোরাবগঞ্জের নুর হোসেনকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইউএনওর সই ছাড়াই মোস্তাফিজুর রহমান ফারুককে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা, তোরাবগঞ্জের আবদুল মালেককে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়। সাবেক ইউএনও ইমতিয়াজ হোসেনের সই জাল করে পাটারিরহাটের মো. হান্নানকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এ ধরনের প্রায় ৭০০ জনকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা উদ্যোক্তা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর প্রায় ৮০ ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ খেলাপি।

এ ছাড়া ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা উদ্যোক্তা ঋণ বিতরণ করার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু, নির্দেশনা অমান্য করে এ শাখায় পাঁচ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থে নির্দেশনা অমান্য করে ঋণের নামে পকেট ভারী করেছেন।

সূত্র জানায়, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করায় জুনিয়র অফিসার গোলাম সারোয়ার ৩১ জানুয়ারি মাঠ সহকারী ইশতিয়াক হোসেনের বিরুদ্ধে শাখা ব্যবস্থাপক সোলেমানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় ইশতিয়াককে শোকজ করা হয়। তিনি জবাব না দিয়ে শাখা ব্যবস্থাপকের ওপর চড়াও হন। এতে ১৬ মার্চ শাখা ব্যবস্থাপক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া ইশতিয়াকের বিরুদ্ধে কম্পিউটার অপারেটর ইব্রাহিম খলিল উল্যাকেও মারধরের অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ শাখা থেকে ১৬ কোটি ৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা গ্রাহকরা ঋণ নিয়েছেন। এতে আট কোটি ৮৩ লাখ টাকা ঋণ খেলাপি রয়েছে। এর মধ্যে ৫-৭ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ খেলাপি ঋণ ৩ কোটি ৮৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা এবং এক বছরের চার কোটি ৯৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। মাঠ সহকারীদের বিরুদ্ধে ৬ মার্চ অডিটে ৪৫ লাখ টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে নিয়ে ব্যাংকে জমা না দেওয়ার সত্যতা মেলে। পরে অডিট টিমের নির্দেশে ওই টাকা ব্যাংকে জমা দেয় মাঠ সহকারীরা।

চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের তথ্যে জানা গেছে, সাহেবের হাট ইউনিয়নের মাঠ সহকারী মো. রাশেদের অধীনে ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, তোরাবগঞ্জের রাকিবুল হাসানের অধীনে ৫৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা, নুরুল করিমের অধীনে ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, চরকাদিরার শামীম হাসানের অধীনে ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, ইসমাইল হোসেনের অধীনে ৪৬ লাখ ৮ হাজার টাকা, পাটারীরহাটের আবদুল খালেকের অধীনে ৭৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা, মো. ফারুকের অধীনে ৫৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা, চরমার্টিনের আবুল বাশারের অধীনে ৪৭ লাখ ৮ হাজার টাকা, আবুল কালামের অধীনে ৭৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা, চরফলকনের প্রমিলা রাণী মণ্ডলের অধীনে ৭৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা, চরকালকিনির কামাল উদ্দিনের অধীনে ৪৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, জসিম উদ্দিনের অধীনে ৫৭ লাখ ৪ হাজার টাকা, চরলরেন্সের মাইন উদ্দিনের অধীনে ৭৪ লাখ ১৮ হাজার টাকা, আইয়ুব আলীর অধীনে ৫৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা এবং হাজিরহাটের ইশতিয়াক হোসেনের অধীনে ৫৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। 

উপজেলা পরিষদে চরকালকিনি ও হাজিরহাট ইউপির পাঁচ জন সদস্যের (মেম্বার) সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, প্রকৃত গ্রাহকেরা ঋণ পান না। তাঁদের হয়রানি হতে হয়। মাঠের কর্মকর্তারা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ঋণ করে টাকা উত্তোলন করে নিজেরা ব্যবসা করেন। পরে অফিসে বলেন, নদীভাঙার কারণে ঋণ নেওয়া লোকজন ভোলা-বরিশাল চলে গেছে। এতে সরকারের উদ্দেশ্য ভেস্তে যাচ্ছে।

গ্রাহক নিজাম উদ্দিন সোহেল বলেন, ‘চরলরেন্সের মাঠ সহকারী মাইন উদ্দিন আমার ১৯ হাজার টাকা নিয়ে ব্যাংকে জমা দেননি। পরে অডিট টিম ও ব্যাংক ব্যবস্থাপকের কাছে বিচার দিলে তিনি ওই টাকা জমা দেন। কৌশলে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি আত্মসাৎ করেন।’

এ বিষয়ে মাইন উদ্দিনের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে কল করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে, ইশতিয়াক হোসেন বলেন, ‘কাউকে ভয়ভীতি ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতের ঘটনা সত্য নয়। জালিয়াতির সঙ্গে আমি জড়িত নই। প্রতিনিয়ত খেলাপি টাকা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি।’

ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ সোলায়মান বলেন, ‘মাঠ সহকর্মীরা নতুন-নতুন নাম দিয়ে সামান্য কিছু টাকা সঞ্চয় জমা দেন। তাঁরাই টাকা নিয়ে গ্রাহকদের দেওয়ার জন্য চাচ্ছেন। গ্রাহকদের সশরীরে উপস্থিত করার জন্য বলা হলেও, তা করতে পারছেন না। এজন্য তাঁরা আমাকে বদলি করানোসহ বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছেন।’

কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘ব্যাংকের অনিয়ম ও মাঠ সহকারীদের জালিয়াতির অভিযোগটি পেয়েছি। এর মধ্যে আমার সই-সিলও জাল করার অভিযোগ আছে, তা তদন্তের জন্য উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’