গাছে লেগে থাকা মাটি থেকে বেরিয়ে এলো জোড়া খুনের রহস্য

Looks like you've blocked notifications!
নারায়ণগঞ্জে মা-ছেলেকে হত্যাকারী সাদিকুর ওরফে সাদিকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। ছবি : সংগৃহীত

জোড়াখুন হওয়া বাড়ির পেছনে সুপারি গাছে লেগে ছিল মাটি। অথচ গাছে ছিল না সুপারি। এতে সন্দেহ জাগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তকারী দলের। জানতে পারে, বাড়ির পেছনে ফ্রি ওয়াইফাই পাওয়া যায়। এজন্য সেখানে বসে কেউ কেউ ইন্টারনেট ব্রাউজ করে। পরে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। জীবনের হুমকি থাকায় এর আগে মুখে খোলেননি তাঁরা।

নারায়ণগঞ্জে সম্প্রতি মা-ছেলের জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটন করে পুলিশের এই তদন্ত সংস্থাটি জানায়, টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেওয়ার কারণেই কাকলি ও তার ছেলে তালহাকে গলা কেটে হত্যা করেছে প্রতিবেশি যুবক সাদিকুর ওরফে সাদি। আজ সোমবার দুপুরে পিবিআইয়ের সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।

এর আগে গতকাল রোববার গ্রেপ্তার সাদিকুর ওরফে সাদি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাওসার আলমের আমলি আদালতে এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, সুপারি গাছে লেগে থাকা মাটি দেখে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ব্রাহ্মণদী ইউনিয়নের উজান গোবিন্দি এলাকার লোমহর্ষক রাজিয়া সুলতানা ওরফে কাকলি এবং তাঁর শিশু ছেলে তালহা হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচন করেছে নারায়ণগঞ্জ পিবিআই।

পিবিআই জানায়, চলতি বছরের ৩ জুলাই ভোর সাড়ে ৫টার দিকে নিহত কাকলির বাবাকে তাঁর স্বামীর বাড়ি থেকে ফোন করে জানানো হয়, তাঁর মেয়ে কাকলি ও তাঁর ছেলেকে কে বা কারা হত্যা করেছে। এই খবর পেয়ে কাকলির বাবা তাঁর মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন যে, ২ জুলাই রাত আটটার দিকে কাকলি ও তাঁর ছেলে প্রতিদিনের মতো রাতের খাবার শেষ করে তাদের নিজেদের ঘরে শুয়ে পড়ে।

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘পরদিন ভোর পৌনে ৪টার দিকে পাশের ঘরে কাকলির চাচাতো ভাইয়ের বউ জান্নাত ঘুম থেকে ওঠে ফজরের নামাজের ওজু করার জন্য বাইরে যান। তখন কাকলির বসত ঘরের কলাপসিবল গেট খোলা দেখতে পান। জান্নাত তখন ঘরের ভেতরে ঢুকে কাকলি ও তাঁর ছেলের গলাকাটা মরদেহ দেখতে পেয়ে চিৎকার করেন। তাঁর চিৎকারে বাড়ির অন্যান্য লোকজন এসে দেখতে পায়—রাজিয়া সুলতানা কাকলির মরদেহ ঘরের দক্ষিণ পাশের রুমের মেঝেতে গলাকাটা অবস্থায় পড়েছিল। তাঁর ছেলে তালহার মরদেহও ঘরের উত্তর পাশের কক্ষে খাটের ওপর গলাকাটা অবস্থায় পড়েছিল। হত্যায় ব্যবহৃত বটি ছেলের মরদেহের পাশেই বিছানার ওপর রক্তমাখা অবস্থায় পাওয়া যায়।’

পিবিআই বলছে, ২ জুলাই রাত আটটা থেকে ৩ জুলাই পৌনে পাঁচটার মধ্যে যে কোনো সময় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় নিহত কাকলির বাবা বাদী হয়ে ৫ জুলাই আড়াইহাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার বলেন, ‘লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডে ঘটনাটি সারা দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলে আড়াইহাজার থানা পুলিশ, সিআইডি, র‌্যাবের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের পিবিআইও ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে ছায়াতদন্ত শুরু করে। নারায়ণগঞ্জের পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলামের সার্বিক সহযোগিতায় মামলাটি গত ৯ জুলাই স্বউদ্যোগে গ্রহণ করে পিবিআই।’

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) শাকিল হোসেন এবং প্রত্যক্ষভাবে সহযোগী (এসআই) মো. মাজহারুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করেন।

পিবিআই জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর পিবিআই মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায়। পরিদর্শনের এক পর্যায়ে তদন্তকারী দল নিহত কাকলির বসতঘরের পেছনে দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো সুপারি গাছের গোড়া থেকে আনুমানিক দুই ফুট ওপরে এক জায়গায় সদ্য মাটি লাগানো দেখতে পায়। তখন তদন্তকারী টিম সুপারি গাছের ওপরে দিকে তাকিয়ে দেখে গাছে কোনো সুপারি নেই। এই বিষয়টি তদন্তদলের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। পিবিআইয়ের চৌকস দল সঙ্গে সঙ্গে লোকাল সোর্সের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারে ওই বাড়ির পেছনে ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগ থাকায় নিহত রাজিয়া সুলতান ওরফে কাকলির ভাসুরের ছেলে অজিত কাজীসহ আরও দু’একজন ছেলে ওই বাড়ির পেছনে বসে ফ্রি ওয়াইফাই দিয়ে মোবাইলে নেট ব্রাউজ করে থাকে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এই তথ্য পেয়ে অজিত কাজীসহ অন্যান্যদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে কাকলির ভাসুরের ছেলে অজিত কাজী জানায়, তিনি ২ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাকলির বাড়ির পেছনে দেওয়াল ঘেঁষে বসে ওয়াইফাই সংযোগের সাহায্যে মোবাইলে গেমস খেলছিলেন। এসময় হঠাৎ তালহার চিৎকারের শব্দ শুনতে পান। তারপর তিনি কাকলির বাথরুমে কারও হাত ধোয়ার শব্দ শুনতে পান। এরপর কাকলির বিল্ডিংয়ের পেছনে দেওয়ালে লাগানো সুপারি গাছ বেয়ে ওপরে ওঠেন। পরে বাথরুমের ভেনটিলেটর দিয়ে উঁকি দিয়ে পাশের বাড়ির সাদিকুর ওরফে সাদিকে কাকলির রুমের অ্যাটাস্ট বাথরুমের পানির কলে হাত ধুতে দেখেন।

তখন অজিত সাদিকুরকে দ্রুত ওই ঘর থেকে বের হতে দেখেন। সাদিকুর বের হয়ে যাওয়ার সময় ঘরের পেছনে অজিদ কাজীকে দেখতে পায়। পরে সকাল বেলা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আসামি সাদিকুর অজিত কাজীর সঙ্গে দেখা করে বলে, ‘আমার কথা কাউকে বললে তোরে জানে মেরে ফেলব।’ এই ভয়ে অজিত কাজী ঘটনা চেপে যায়।

সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘এই তথ্য পাওয়ার পরই পিবিআইয়ের তদন্তকারী টিম সাদিকুর ওরফে সাদিকে তাঁর নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। ব্যাপক ও নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদে আসামি সাদিকুর ওরফে সাদি পিবিআইয়ের তদন্তকারী দলের কাছে এই জোড়া খুন মামলায় নিজের সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়।’

পরে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি লোহার হাতলযুক্ত বটি, কাপড় ইস্ত্রির একটি ইলেকট্রিক মেশিন, একটি রক্তমাখা ওড়না জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে লুট করা স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করা হয়।