গ্রাহকের শত কোটি টাকা আত্মসাৎ, আটক ১০
ঢাকার আশুলিয়ায় কোটি কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা ‘চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’-এর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জনকে আটক করেছে র্যাব। গতকাল মঙ্গলবার থেকে আজ বুধবার পর্যন্ত আশুলিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের আটক করা হয়।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আজ বুধবার দুপুরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-৪-এর পরিচালক মোজাম্মেল হক।
আটক হওয়া ব্যক্তিরা হলেন—ইকবাল হোসেন সরকার (৩৫), মাজহারুল ইসলাম (৩৫), মমিন হোসেন (৩৫), জাহাঙ্গীর আলম (৩৫), ইব্রাহিম খলিল (৩৫), এস এম মকবুল হোসেন (৪০), মিজানুর রহমান (৩৮), আল আমিন হোসেন (২৮), ফজলুল হক (৩৫) ও নুর হোসেন (২৭)।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আশুলিয়ায় জামগড়া এলাকায় অবস্থিত ‘চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের প্রায় শতাধিক কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়ে যায়। পরে এ ঘটনায় প্রায় পাঁচ শতাধিক গ্রাহক তাঁদের জমা করা টাকা ফেরত পেতে গত ১৯ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির জামগড়া অফিসের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
শতাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গণমাধ্যম থেকে এসব তথ্য জানা যায়। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, সহস্রাধিক পরিবারের প্রায় শতাধিক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এ চক্রটি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা জানান—ধর্মকে ব্যবহার করে উচ্চ মুনাফার আশা দেখিয়ে বিভিন্ন সময় তাঁদের কাছে থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
প্রথমে দিকে ঠিকঠাক মতো লভ্যাংশ দেওয়া হতো। পরে লভ্যাংশ দূরের কথা, মেয়াদ পূর্ণ হলেও আসল টাকা দিতে শুরু করে নানা তালবাহানা।
সব শেষে ভুক্তভোগীরা আসল টাকা ফেরত চাইলে গত শনিবার সকালে টাকা দেওয়ার কথা বলে গ্রাহকদের শতাধিক কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়ে যায় এ প্রতারক চক্র।
অভিযানে চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের অফিস থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত ভর্তি ফরম, ঋণ গ্র্রাহকদের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র, ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকদের জীবন বৃত্তান্ত, লিফলেট, সিল, বিভিন্ন নামে সঞ্চয় পাস বই, অব্যবহৃত পাশ বই, দৈনিক কিস্তি এবং ঋণ বিতরণের বিভিন্ন রেজিস্টার, ব্যাংক চেক, টাকাসহ আরও কিছু কাগজপত্র জব্দ করা হয় বলে সংবাস সম্মেলনে জানায় র্যাব।
মোজাম্মেল হক গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে বলেন, ‘২০০৮ সালে ৩০ সদস্য-বিশিষ্ট গভর্নিং বডির সদস্য চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও স্বল্পআয়ের মানুষজনকে অধিক মুনাফায় সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণের প্রতি আকৃষ্ট করত। ধীরে ধীরে এ সংস্থার বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। একই সঙ্গে চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের ব্যানারে আরও বড় পরিসরে কাজ করা শুরু করে।’
র্যাবের এ কর্মকর্তা আরও জানান, চক্রটির মূল টার্গেট ছিল আশুলিয়া ও সাভারের ইন্ডাস্ট্রিজ এলাকার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত লোকজন। তাদের অতি উচ্চ মুনাফা প্রদানের আশ্বাসে কোম্পানিতে সঞ্চয়ী পলিসি, এফ ডি আর, ডিপিএস, পেনশন পলিসি, শিক্ষা পলিসি, হজ্ব পলিসি, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী পার্টনার পলিসিতে আকৃষ্ট করত। এমন চটকদার ১৮ থেকে ৩০ শতাংশ হারে মুনাফা এবং ফিক্সডিপোজিটের ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ বছরের ডাবল লাভ প্রদানের আশ্বাসে প্রায় সহস্রাধিক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জীবনের সমস্ত অর্জিত আয় উক্ত সমিতিতে জমা রাখতে উৎসাহিত করত।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, ভুক্তভোগীদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সংস্থাটি প্রথম দিকে কয়েক মাস গ্রহকদের চুক্তি অনুযায়ী লভ্যাংশ দিত। এ সব দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হতেন। অনেকে নিজের পেনশনের টাকা, গ্রামের ভিটেবাড়ি বিক্রি করা টাকা, বিদেশ থেকে কষ্ট করে অর্জিত অর্থ ওই সংস্থায় উচ্চ মুনাফা লাভের আশায় জমা রাখতেন।
এমন অবস্থায়, আসামিরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৬ মার্চ অফিস তালা দিয়ে লাপাত্তা হয়।
র্যাব অসুন্ধান করে জানতে পারে, প্রতিষ্ঠানটির অংশীদারেরা বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে জায়গা-জমি কেনা, বহুতল ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন ছোট বড় কারখানা করেছে এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে বিভিন্নভাবে অর্থ বিদেশে পাচার করেছে।
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কমিটির সভাপতি পলাতক মুহাম্মদ উল্লাহ আশুলিয়ার নরসিংহপুরে বসবাস করলেও তিনি মূলত বরিশালের ভোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ড্রাইভার। তিনি ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। আশুলিয়ায় তাঁর পাঁচতলা বাড়ি এবং একাধিক ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গ্রেপ্তার করা ইকবাল হোসেন সরকার মুহাম্মদউল্লাহর বন্ধু। তিনি এ সমিতির সহসভাপতি। তাঁর আশুলিয়া জামগড়াতে পাঁচতলা বাড়ি এবং সাভার ও আশুলিয়াতে একাধিক ফ্লটের সন্ধান পাওয়া গেছে। মো. মাজহারুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক, তাঁরও সাভার-আশুলিয়া এলাকায় একাধিক বহুতল বিশিষ্ট বাড়ি ও প্লটের সন্ধান পাওয়া গেছে। মমিন হোসেন যুগ্ম-সম্পাদক, জাহাঙ্গীর আলম কোষাধ্যক্ষ; তাঁদেরও সাভার আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকায় একাধিক বাড়ি রয়েছে। এ সমিতির তথাকথিত চেয়ারম্যান এবং বিগত কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলামের আশুলিয়ার ইসলাম নগর এলাকায় একাধিক ভবন এবং প্লটের সন্ধান পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ভুক্তভোগীদের টাকা আত্মসাৎ করে এসব জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন তাঁরা। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে র্যাব জানিয়েছে।