সিডরের ১৪ বছর

ঘূর্ণিঝড়ের মতোই লণ্ডভণ্ড সেই সিডরের জীবন

Looks like you've blocked notifications!
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের রাতে খুলনার মোংলায় আশ্রয়কেন্দ্রে জন্ম নেওয়া সিডর সরকার। ছবি : এনটিভি

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাত। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সেদিন চলছিল ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাত। সেই ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল পুরো দেশের উপকূলীয় এলাকা। ঝড়ের রাতে খুলনার মোংলা উপজেলার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিল শত শত মানুষ। তাদের মধ্যে ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা সাথী সরকার। ওই রাতে আশ্রয়কেন্দ্রেই সাথীর কোলে জন্ম নেয় একটি শিশু। ঝড়ের ধ্বংসলীলা আর হাজারো মৃত্যুর মধ্যেই পৃথিবীতে আসে নতুন একটি মুখ। তাই শিশুটির নাম রাখা হয় সিডর সরকার। তবে ঘূর্ণিঝড়ের পরে সৃষ্ট নানা ঝড়ে প্রায় লণ্ডভণ্ড হয়েছে তার জীবর। ভাগ্য তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে ঠিকই। তবে ১৪ বছর বয়স্ক সিডর সরকারের জীবনে নিভে গেছে সুখের বাতি।

ঝড়ের রাতে জন্ম নেওয়ায় সিডর সরকার অনেক গণ্যমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। তবে তাতে ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এতে আক্ষেপ রয়েছে শিশুটির পরিবার ও গ্রামবাসীর। দরিদ্র, দিনমজুর ও জেলে বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া সিডরের মা ঘর বেঁধেছে অন্য কোথাও। বাবাও কাজের কারণে থাকেন ঘরের বাইরে। পাশে নেই মা, বাবা থেকেও না থাকার মতোই। এমতাবস্থায় সিডর থাকেন দাদির কাছে। পরিবারের মমতা থেকে বঞ্চিত সিডরের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারে।

মোংলার কানাইনগর গ্রামের জেলে ও দিনমজুর বাবা জর্জি সরকারের (৩৮) একমাত্র ছেলে সিডর। শত অভাবের মধ্যেও বাবা জর্জি সিডরকে গ্রামের সেন্ট লুকস প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার পর সিডরকে ভর্তি করা হয় খুলনার দাকোপ উপজেলার বাজুয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে চতুর্থ থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে সিডর। কিন্তু হোস্টেল খরচ মেটাতে না পারায় কয়েক মাস আগে বাড়িতে ফিরে আসে। খরচ বহনের সামর্থ না থাকায় সেখানে আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে গ্রামে থেকে শহরের কোনো একটি স্কুলে নতুন করে ভর্তি হতে হবে সিডরকে। তবে নতুন স্কুলে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার কোনো অবস্থা নেই দিনমজুর বাবার।

বর্তমানে সিডরের বাবা জর্জি গেছেন দুবলার চরে জেলে শ্রমিকের কাজে। সেখান থেকে এখনও কোনো খরচ পাঠাতে পারেনি তিনি। তাই খেয়ে না খেয়ে, ধার দেনা ও বাকিতে সদাই কিনে দিন কাটাচ্ছে সিডর ও তার দাদি।

এর মধ্যে আবার মা নেই কাছে। চার বছর আগে মা সাথী সরকার (৩৪) ছেলে সিডর ও পরিবার ফেলে চলে গেছেন অন্যত্র। অন্যত্র সংসার করায় মা কোনো খোঁজ নেন না সিডরের। এখন সিডরের শেষ আশ্রয়স্থল দাদি রিভা সরকার (৫৫) ও চাচা সাগর সরকার (২৮)। সিডরের লেখাপড়া নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে তার দাদি ও চাচা। অভাবের মধ্যে সিডরকে কোথায় কীভাবে পড়াবেন তা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না।

এত কষ্টের মধ্যেও লেখাপড়ার আগ্রহ রয়েছে সিডরের। তবে নতুন বছরে নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়াটা এখন অনিশ্চিত। লেখাপড়া করতে না পারলে হয়তো বাবার মতোই নদীতে মাছ ধরতে হবে অদম্য মেধাবী সিডরকে। এ অবস্থায় সিডরের লেখাপড়া ও কোনোভাবে বেঁচে থাকার জন্য সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছে তার পরিবার। 

সিডরের দাদি রিভা সরকার (৫৫) বলেন, ‘আমাদের পরিবারের অবস্থা খারাপ। নাতিকে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। সিডরের বাবাও অসুস্থ, একটা হাত ভাঙা। তারপরও আয়ের প্রয়োজনে কাজে গেছে। সিডরের লেখাপড়ার খুব আগ্রহ। কিন্তু আমি পারছি না, যেখানে ছিল সেখানে খরচ দিতে না পারায় এখন বাড়ি এসে বসে আছে। এত কষ্ট এখন, ওকে খাওয়াবো না পড়াবো? সবাই যদি সহায়তা করে, তাহলে সিডরকে লেখাপড়া করানো সম্ভব হবে।’

সিডরের চাচা সাগর সরকার (২৮) বলেন, ‘সিডর খুব মেধাবী, লেখাপড়ায় অনেক আগ্রহ। শহরের স্কুলে ভর্তি, বই-খাতা, পোশাকের পাশাপাশি প্রয়োজন বাইসাইকেল। দরকার অ্যাসাইনমেন্টের জন্য মোবাইল ফোনেরও। এসব সহায়তা পেলে লেখাপড়া শিখে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে সিডরের। বিভিন্ন সময়ে অনেকেই সিডরকে সহায়তার আশ্বাস দিলেও এ পর্যন্ত কেউ কিছুই করেনি।’

সাগর সরকার আরও বলেন, ‘১৫ নভেম্বর এলে শুধু সাংবাদিকরা খোঁজ নিয়ে রিপোর্ট করেন। কিন্তু এতে সিডরের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। লেখাপড়া চালানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই সমাজের বিত্তবানের এগিয়ে এলে সিডরের ভর্তি ও পড়ালেখা সম্ভব হবে।’

সিডর সরকার বলেন, ‘আগে আমি বাজুয়ায় হোস্টেলে থাকতাম। বাবা ও দাদি খরচ দিতে না পারায় সেখান থেকে চার মাস হলো বাড়িতে চলে এসেছি। বাবাতো ঠিক মতো খাওয়াতেই পারছে না, লেখাপড়া কিভাবে শিখব? পড়ালেখা শিখতে না পারলে আমাকে জাল টেনে খেতে হবে। আমি তা চাই না। আমি পড়তে চাই।’

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কমলেশ মজুমদার বলেন, ‘সিডরের কথা তো এক সময়ে খুব শোনা গেছে, এখনও শোনা যাচ্ছে। তবে আমি যতটুকু জানতাম সে একটি স্কুলে পড়ত। তবে সিডরের বিষয়ে সহযোগিতার জন্য সে কিংবা পরিবারের কেউ কোনো আবেদন করেননি। তবে জানতে পেরেছি তার লেখাপড়ার বিঘ্ন ঘটেছে। সে উপজেলার মধ্যে কোনো স্কুলে ভর্তি হতে চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দেব। আর তার পারিবারিক সমস্যার ক্ষেত্রে যদি আবেদন করে তাও সমাধানের চেষ্টা করব।’

জন্মের পর থেকেই প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে আসছে সিডর। শিরোনাম দেখে সেই সময়ে বিভিন্ন মানুষ তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও তা কেউই বাস্তবায়ন করেনি। তাই এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সিডরের পরিবারের। এ অবস্থায় সমাজের বিত্তবানদের সহায়তাই বদলে দিতে পারে সিডরের ভবিষ্যৎ।