চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন হচ্ছে না পাহাড় কাটা বন্ধের সিদ্ধান্ত

Looks like you've blocked notifications!
চট্টগ্রামে আতঙ্কে দিন পার করেন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দারা। ছবি : এনটিভি

চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে প্রতিনিয়ত তাড়া করে মৃত্যুর হাতছানি। সবসময় আতঙ্কে দিন পার করেন এসব পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দারা। প্রবল বর্ষণ হলেও নিজেদের বসতবাড়ি ছাড়তে চায় না তারা। জলবায়ু পরিবর্তনের তহবিল থেকে ৪০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে গৃহহীনদের পুনর্বাসনের উদ্যোগও থেমে গেছে। পাহাড়ে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের সিদ্ধান্ত সাত বছরেও কার্যকর হয়নি। ফলে, পাহাড়ে মৃত্যুর মিছিল প্রতিবছর বাড়ছে। জেলা প্রশাসন বলছে, সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া একার পক্ষে পাহাড় রক্ষা সম্ভব হবে না।

এদিকে, দিনের পর দিন অরক্ষিত হয়ে পড়ছে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো। একটানা বর্ষণ হলে পাহাড় ধসের ঘটনাও বেড়ে যায়। নগরীর প্রাণকেন্দ্র লালখান বাজার, আকবর শাহ এলাকা, গরীব উল্লাহ শাহ আবাসিক, আমবাগান, অক্সিজেন, জালালাবাদ এলাকার পাশাপাশি বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিঙ্করোড এলাকার পাহাড়গুলো আগেই বেদখল হয়ে গেছে। মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে মাইকিংসহ সচেতনতা তৈরিতে নানা উদ্যোগ কাজে আসছে না। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখার জন্য মৃত্যুর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এসব এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করে অনেকে।

পাহাড়গুলোতে দেখা গেছে, বন-জঙ্গল ও পাহাড় কেটে সড়কসহ নানা স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। আবার সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন এনজিওগুলো কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক নির্মাণসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করা হয়েছে। তবে, এসব পাহাড় কাটাসহ নানা অনিয়মের কথা অস্বীকার করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

কারা পাহাড় কাটছে জানতে চাইলে আকবর শাহ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম বলেন, ‘যার যার পাশে... এখানে তো কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বস্তির লোকজন এখানে ৩০ বছর ধরে বসবাস করছে। দেখা গেল, আশপাশে পাহাড় আছে, জায়গা বাড়ানোর জন্য রাতের অন্ধকারে আরেকটু কাটে। কেউ কেউ বাড়ি পাকা করছে। এভাবেই বসবাস করে তারা। তারপরও আমরা যতটুকু সচেতন করা যায়, চেষ্টা করছি। গতবারও এমন বর্ষাকালে আমরা আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছিলাম। আমাদের যতটুকু করার, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

চট্টগ্রাম সিটির সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাসলিমা নুরজাহান বলেন, ‌‘নিম্ন-আয়ের মানুষ, যারা একবারে দিনমজুরের মতো, তারা ছোট্ট একটু জায়গা নিয়ে, হয়তো কারও কাছ থেকে কিনেছে... এরপর ওরা নিজেরাই জায়গা বাড়িয়ে নিয়েছে। দেখা গেল, একটু ভেঙেছে, মাটি সরিয়ে নিচ্ছে। এখানে এভাবেই চলছে। আমরা সব সময় চাই যে, যারা নিম্ন-আয়ের মানুষ, তারা যেন এভাবে বসবাস না করে। গত বছরও আমরা কিন্তু এভাবেই হয়রানি হয়েছি। উনারা (বাসিন্দারা) বলেন যে, গত ২৬ বছরেও দুর্ঘটনা হয়নি। আজ যে দুর্ঘটনা হলো, এর দায় কে নেবে? আমরা কি তাদের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারব? তো, আমরা এদের এখনও সতর্ক করছি, আগামী সময়েও করব এবং আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই দাবি করব, হতদরিদ্রের জন্য যে বাসস্থানের ব্যবস্থা তিনি করছেন, আমাদের এই নিম্ন-আয়ের মানুষগুলোর জন্যও যেন তিনি ব্যবস্থা করেন। তাদের যদি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেন, তাহলে মনে হয় অন্তত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে, মৃত্যুর এই গহ্বর থেকে মানুষ বাঁচতে পারবে।’

পরিবেশবিদেরা জানান, ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঘটনায় ১২৭ জনের মৃত্যুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৩০০ জন প্রাণ হারালেও সরকারের কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের বড় ধরনের ভূমিকা ছাড়া এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগের সভাপতি ড. অলক পাল বলেন, ‘চট্টগ্রামের যে অনন্য সৌন্দর্য্য, এর বড় একটি জায়গা হচ্ছে এখানকার পাহাড়। এসব পাহাড়ে যেভাবে মানুষজন বসবাস করে, বা মানুষজনকে আমরা বসবাস করতে উৎসাহ দিই, আমার মনে হয়—এখানে জনপ্রতিনিধিদের আরও বড় রকমের ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকা থাকা দরকার যে, কী পরিমাণ মানুষ থাকতে পারবে এবং কী পরিমাণ মানুষের আসলে এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত।’

জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান জানান, নগরীর পাহাড়গুলোতে হাজার হাজার মানুষ বাস করে। এসবের মালিক সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও পুনরায় দখল হয়ে যায় বলে অসহায়ত্বের কথা জানান তিনি।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আপনারা জানেন, যে পাহাড়গুলো রয়েছে, এগুলো বিভিন্ন সংস্থার মালিকানায় রয়েছে। কিছু পাহাড়ের মালিক রেলওয়ে, কিছুর মালিক সিডিএ, কিছুর মালিক সিটি করপোরেশন, কিছুর মালিক গণপূর্ত বিভাগ। এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন কিছু পাহাড়ও রয়েছে। আমরা প্রতিবছর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি। কিন্তু, পাহাড়গুলো যাদের মালিকানাধীন, উচ্ছেদ করার পর সেগুলো যদি তারা নিজেদের দখলে না রাখতে পারে এবং সেখান থেকে যদি (অবৈধভাবে বসবাসকারীদের) সরিয়ে না দেয়, তাহলে এটি আমাদের একার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে হতাহতের ঘটনা চলতে থাকবে। আমরা সবাইকে অনুরোধ করছি—অবৈধ বসতিগুলো থেকে কেবল বিদ্যুৎ সংযোগই নয়, এখান থেকে পানি, গ্যাস সংযোগসহ যে রাস্তাঘাট করে দেওয়া হয়েছে—তো, আমরা সব বিভাগকে অনুরোধ করব, নির্দেশনা দেব, যাতে করে এখান থেকে সবাই যার যার মতো করে সরে যায়।’

চট্টগ্রামের ২৮টি পাহাড়ে অবৈধ বসতঘর আছে প্রায় দুই হাজার। এসব স্থাপনায় বাস করছে ৫০ হাজারের বেশি  মানুষ। জলবায়ু তহবিলের অর্থে চট্টগ্রাম শহর এলাকায় গৃহহীন, ভাসমান লোকদের জন্য স্বল্পমূল্যের ফ্ল্যাট নির্মাণের সিদ্ধান্তও কাগজে-কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।