ছেলেকে জঙ্গিদলে পাঠিয়ে মায়ের আহাজারি
মায়ের কান্না আর আহাজারিতে সংবাদ সম্মেলন কক্ষ তখন স্তব্ধ। কান্নাভেজা কণ্ঠে কথা বলতে বলতে তিনি কখনও থেমে যান, ফের শুরু করেন। তাঁর কথা ও দীর্ঘশ্বাস আর থেমে যাওয়া সময়ের নিস্তব্ধতায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। ‘ভদ্র, বিনয়ী’ ছেলেটাকে প্রাইভেট টিউটরের কথায় তথাকথিত হিজরতে পাঠিয়ে দিশেহারা মা বলেন, ‘আব্বু, যদি তুমি আমার ম্যাসেজ পেয়ে থাক, বলতে চাই—তুমি চরম একটা ভুল পথে আছ। তুমি তোমার এই মাকে বিশ্বাস করতে পার।...আমি অনুরোধ করছি—তুমি আত্মসমর্পণ করো, প্রশাসন সদয় হবেন।’
মাত্র ১৫ বছর বয়সী ছেলে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান এ আকুতি শুনছে কি না জানেন না মা আম্বিয়া সুলতানা এমিলি। এক সময়ে বিমানের কেবিন ক্রু ছিলেন মাস্টার্স পাস করা এই নারী। তবুও একমাত্র সন্তানের প্রাইভেট টিউটরকে বিশ্বাস করে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন জঙ্গিবাদে। ছেলেকেও জড়িয়ে ফেলেন সে পথে। গত মার্চে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামের জঙ্গি সংগঠনে ছেলেকে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠান তিনি।
এখন মা এমিলি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন। তিনি তাঁর ছেলেকে ফেরত চান। আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
গণমাধ্যমের সামনে ১০ মিনিটের মতো কথা বলেন আম্বিয়া সুলতানা এমিলি। এমিলি তাঁর ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আব্বু…তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনও তোমার এই মাকে ভালোবেসে থাক, তাহলে তুমি দেশের জন্য কোনো ধরনের হুমকির কাজ করবে না। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৃসংশতা, অন্যায় কাজে শামিল হবে না।’
কিছুদিন আগে বাসা ছেড়ে জঙ্গি হওয়া ৫৫ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে র্যাব। সেই তালিকায় ছিল আবু বক্করের নাম।
গত ৩ নভেম্বর অভিযানে র্যাব সংগঠনের মহিলা শাখা সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় এবং জানতে পারে যে, একজন মা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া তাঁর সন্তানকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছেন।
এরপর র্যাব প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ ও নজরদারির মাধ্যমে আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলিকে গত ৫ নভেম্বর উদ্ধার করে এবং তাঁকে পরিবারের সান্নিধ্যে রেখে গত চার দিন ধরে ডি-রেডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
আজ সংবাদ সম্মেলনে এমিলি কথা বলার আগে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘আবু বক্করের শিক্ষক আল আমিনের মাধ্যমে আম্বিয়া সুলতানা এমিলি ও আবু বক্কর ২০২১ সালের প্রথম দিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন এবং সংগঠনে যোগদান করে।’
পরে আবু বক্কর চলতি বছরের মার্চে ওই শিক্ষকের নির্দেশনায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু, এরপর আর বাড়িতে ফিরে আসেনি।
গতকাল গ্রেপ্তার জঙ্গি সংগঠনের তিন সদস্যের একজন রনির দেওয়া তথ্যমতে, অন্যান্য প্রশিক্ষণ শেষ হলে আল আমিনের নির্দেশে আবু বক্করকে গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানে দিয়ে আসে।
র্যাব জানায়, আবু বক্করের মা এমিলি তাঁর ছেলের অবস্থান সম্বন্ধে জানলেও পরিবারের সদস্যদের কাছে গোপন রাখেন। এদিকে, আবু বক্করের বাবা থানায় তাঁর ছেলে নিখোঁজের জিডি করেন এবং ছেলের সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হন।
অন্যদিকে, ছেলে পাহাড়ে প্রশিক্ষণে যাওয়ার পর সন্তানের কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে মা এমিলি সন্তানের চিন্তায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকেন। পরে সন্তানকে ফিরে পেতে ও নিজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এমিলি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, চরম ভুল একটা পথকে সঠিক মনে করে সন্তানকে দিয়েছিলাম। এ কারণে এখন আমার আদরের সন্তান বান্দরবানের পাহাড়ে। আমি জানি না, আমার সন্তান বেঁচে আছে কি না। জানি না, আমি কখনও দেখতে পাব কি না। এটা মা হিসেবে চরম ব্যর্থতা।’
কোরআন ও হাদিসের ভুল ব্যাখ্যায় ‘আমাকে ডি-মোটিভেটেড করা হয়েছে’ উল্লেখ করে এমিলি বলেন ‘আমার সন্তান আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানকেও মিসগাইড করা হয়েছে। জঙ্গিদের গ্রুপ, সংগঠনের নাম, তাদের কর্মকাণ্ড সব কিছু আমার কাছে গোপন করা হয়েছিল।’
মা এমিলি বলেন, ‘ও আমার কলিজার টুকরা। মেধাবী ছাত্র, বিনয়ী ছিল। দুষ্টু বাচ্চার জন্য মায়ের একটু কষ্ট থাকতে পারে। কিন্তু, আমার রিয়াসাদ রাইয়ান ছিল বিনয়ী, ভদ্র ও খুবই অবিডিয়েন্ট। বিপথে নেওয়ার জন্য আমার মতো ছেলেদেরই টার্গেট করা হচ্ছে। যার শিকার আমিও হয়েছি।’
এমিলি আরও বলেন, ‘একজন মা কখনও চায় না তাঁর আদরের সন্তান বিপথে চলে যাক। সন্তান যতোই খারাপ হোক না কেন, মা কখনও তা চায় না। কিন্তু, সন্তানসহ আমি ডিমোটিভেড হয়ে গিয়েছিলাম।’
আম্বিয়া সুলতানা এমিলি আরও বলেন, ‘আমার সন্তান চলতি বছরের ১৫ মার্চ ঘর থেকে বেরিয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে তার শিক্ষক আল আমিন দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে যোগাযোগ করেন। আল আমিন আমাদের খুবই বিশ্বস্ত ছিল। ভদ্র বিনয়ী আল আমিন খুব ভালো পড়াতেন বলে আমরা তাকে খুবই পছন্দ করতাম। তিনি আমাদের ডিমোটিভেট করেছেন।’
জঙ্গিবাদে জড়ানো সন্তান রিয়াসাদ রাইয়ানকে উদ্দেশ করে এমিলি বলেন, ‘তোমার বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে গেছে। আমি খুব ভয় পাচ্ছি, যদি তাঁর কিছু হয়ে যায়। তোমার নানা-নানি সবার অবস্থা খারাপ। তোমার চাচা, আত্মীয়-স্বজন সবাই পাগল প্রায়। মা হিসেবে, তোমার বাবার জন্য চরম ব্যর্থতা হবে যদি তুমি বিশৃঙ্খলা করো, নৃশংস কিছু করো। তুমি তোমার বাবা-মাকে অপমানিত করো না। এই দেশে জন্ম নিয়ে তুমি অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছ।’
আম্বিয়া সুলতানা এমিলি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ করছি—আমাদের ছোট ছোট সন্তানেরা পাহাড়ে দিন-মাস না খেয়ে কাটাচ্ছে। ওরা তো ঘরেই ছিল, মায়ের বুকে ছিল। ওরা ওখানে কীভাবে বাঁচবে? ওরা নিজেও জানে না, কোথায় তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদের ফিরিয়ে আনুন, ওদের সুযোগ দিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার, মায়ের বুকে আসার। ওদের উদ্ধার করুন।’
এরপর আবারও কান্নায় ভেঙে পড়েন এই মা।