দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা, লোমহর্ষক বর্ণনা কিশোরীর

Looks like you've blocked notifications!
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থানা। ছবি : সংগৃহীত

অপহরণের পর ১৭ দিন ধরে আটকে রাখা হয় কিশোরীকে। এ সময়ের মধ্যে পাঁচদিন ধরে তিন যুবক মিলে তাঁকে ধর্ষণ করে। সেই ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা এনটিভি অনলাইনকে দিয়েছেন ওই কিশোরী। সংঘবদ্ধ দলে রয়েছে এক নারীও। পরে চারজনের বিরুদ্ধে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে হয়েছে মামলা। মামলার পর সংঘবদ্ধ দলের ওই নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

আজ বুধবার বিকেলে কিশোরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাজিব কুমার দাস মামলার সত্যতা এনটিভি অনলাইনকে নিশ্চিত করে বলেন, ‘চারজনের বিরুদ্ধে অপহরণ ও গণধর্ষণের অভিযোগ এনে ভুক্তভোগী কিশোরীর বাবা একটি মামলা করেছেন। এ মামলায় তারাজিনা নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

জানা গেছে, দীর্ঘ ১৭ দিন বন্দিত্বের পর ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরী তার পরিবারের কাছে ফিরতে পারে। এরপর স্থানীয় একটি হাসপাতাল ও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখান থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাড়িতে নেওয়া হয়।

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে এ প্রতিবেদকের কথা হয় মেয়েটির সঙ্গে। তখন মেয়েটি চোখেমুখে ভয় লেগেছিল। আতঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। এরপর একটি সময় ভীত সেই মুখ বলতে থাকে লোমহর্ষক সব ঘটনা আর পাশবিক নির্যাতনের কথা।

ভুক্তভোগী মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর দাবি, ধর্ষণের এ ঘটনা কাউকে জানানোর চেষ্টা করলে হত্যার হুমকি দেয় ওই তিন যুবক।

ওই কিশোরীর দাবি, তাঁকে দুই বাড়িতে পর্যায়ক্রমে আটকে রেখে ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এর মধ্যে এক বাড়িওয়ালার সহযোগিতায় ১৭ দিন পর নিজ বাড়িতে পৌঁছায় সে।

হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ওই কিশোরী এনটিভি অনলাইনের কাছে দাবি করে বলেন, ‘গত ২৩ এপ্রিল আমার বাড়ির পাশের উত্তরপাড়ায় খালাবাড়িতে ইফতার দিতে যাই। সেখান থেকে ইফতার শেষে আমি নিজের বাড়ির দিকে রওনা হই। পথিমধ্যে একটি দোকানের সামনে থাকা স্থানীয় তিন যুবক আমার পথ রোধ করে।’

কিশোরীর সে লোমহর্ষক বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ভুক্তভোগী  কিশোরী বলে, ‘আমি ওদের পা ধরেছি, বলেছি কাউকে কিছু বলবো না। আমাকে ছেড়ে দাও। তারপরেও ওরা আমাকে রেহাই দেয়নি।’

কিশোরী বলেন. ‘আমাকে এই কয়েকদিনে ওরা শুধু রুটি খাইয়েছে। ওরা যখন বাইরে যেত, তখন আমাকে তালা মেরে রেখে যেত।’

কিশোরী আরও বলে, ‘৫ দিনের মাথায় ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় একটি অপরিচিত লোক আসে ওই ঘরে। আমাকে ওরা তিনজন বলে ওদের সঙ্গে চলে যা। তখন আমি দেখি ওই অচেনা লোকটা অপহরণকারীদের একজনকে অনেকগুলো টাকা দিল। টাকা পেয়ে সে বলল, তুই ওই লোকের সঙ্গে চলে যা। তোর কিছু হবে না। আর এই কয়দিনে যা কিছু হয়েছে তা ভুলে যা। কাউকে কিছু বলবি না। তোকে ধর্ষণের ভিডিও আছে। বললে সেগুলো নেটে ছেড়ে দেব। তোর বাবা-মাকে মেরে ফেলব।’

কিশোরীর দাবি, ‘ঘরটিতে একটা খাট ও মদের বোতল ছিল। অপরিচিত লোকটা পানি আনার জন্য বাইরে গেলে দরজা আটকে যায়নি। তখন আমি দরজা খুলে দৌড়াই। এ সময় অপহরণকারীদের দুজন আমার পিছু পিছু আসে। কিন্তু, সামনে আরেকজন লোক দেখে ফেলায় তারা পালিয়ে যায়।’

অষ্টম শ্রেণির ওই কিশোরী আরও জানায়, ‘আমি তখন ওই লোকটাকে সব খুলে বলি। তখন তিনি আমার ঠিকানাসহ সব কিছু শুনতে চান। আমি তাকে আমার ঠিকানা বলি। কিন্তু, কোনো ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল না। আমার মাদ্রাসার সামনে ঝালমুড়ি বিক্রেতা এক আপুর নম্বর মুখস্ত ছিল। পরে তার সঙ্গে কথা বলি। আমি তাঁকে (ঝাল বিক্রেতা) সব খুলে বলি, কিন্তু ওর স্বামীও যে আমাকে ধর্ষণ করেছে সেটা বলিনি।’

‘আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে (ঝালমুড়ি বিক্রেতা) ডাকি। তখন রাত ১০টা। কিন্তু আপু বলেন, তোর দুলাভাই যাচ্ছে। তার সঙ্গে আয়। পরে তাঁর স্বামী (তিন জন ধর্ষণকারীর একজন) সেখানে আসে এবং আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোকটার কাছ থেকে নিয়ে যায়। কিন্তু, পথিমধ্যে ওই আপুর স্বামী বলেন, এই অবস্থায় তোকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিশোরগঞ্জে আমার পুরাতন বাড়ি আছে। সেখানে রাতে থেকে কাল সকালে তোকে বাড়িতে রেখে আসব। তখন আমি তাঁর সঙ্গে কিশোরগঞ্জের ওই বাড়িতে যাই।’

কিশোরী বলেন, ‘পরের দিন (২৮ এপ্রিল) সকালে আপু ওই বাসায় আসে। আমি আপুকে বলি বাড়ি রেখে আয়। কিন্তু, তখন আপু বলে, তোর জন্য পাত্র দেখেছি। তোকে বিয়া দিব। তখন আমি তাঁকে বলি আমি এখন বিয়ে করব না। পড়বো। তখন আপু আমাকে বলে, তোর বাপ তো তোকে যৌতুক দিতে পারবে না। তুই বিয়ে কর। তখন আমি না করলে আপু ও তাঁর স্বামী আমাকে মারে। এক পর্যায়ে বলে এখন তোর বাপ আমাদের নামে মামলা করেছে। তোকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না।’

কিশোরী বলেন, ‘ওইদিন বিকেলের দিকে আপু বলে, রংপুরের শঠিবাড়িতে আমার ননদের বাড়ি আছে। সেখানে গিয়ে তুই কিছুদিন থাক। আর কেউ কিছু বললে, তুই বলবি, নিজেই তুই ওখানে গেছিস বিয়ে করার জন্য। যদি এটা না বলিস, তাহলে তোর বাপ মা ভাই বোনসহ তোকে মেরে ফেলবো। পরে তাঁরা আমাকে শঠিবাড়িতে আপুর ননদের স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যান। আমি সেখানে গিয়ে তাদের শেখানো কথা বলি।’

কিশোরী বলেন, ‘অপহরণকারী তিন জন আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়। এক পর্যায়ে বলে, প্রতি রাতে তোকে এক হাজার করে টাকা দেব। তোকে যেখানে পাঠাব সেখানে যাবি। তাহলে তুই ভালো থাকবি। তোর বাপ মাকেও টাকা পাঠাতে পারবি। আমি রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে আবারও টর্চার করে। পরে বিষয়টি আপুর নদদের স্বামীকে খুলে বলি। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি তখন আমাকে বললেন, তোর কিছুই করতে পারবে না ওরা। তোকে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করব।’

কিশোরী আরও বলেন, ‘এরমধ্যে একদিন ঝুলমুড়ি বিক্রেতা আপুর স্বামী আসলে তাঁর ননদের স্বামী বলেন, তোদের সব কথা আমি শুনেছি। তোরা মেয়েটিকে তার বাড়িতে রেখে আয়। তার বাপ মা এবং চেয়ারম্যান মেম্বারকে নিয়ে আয়।’

কিশোরী বলেন, ‘এরপর একদিন আপুর ননদের স্বামী আমাকে রংপুর আনেন। পরে গত ৮ মে রংপুরে এনে তাঁর বন্ধুর গাড়িতে তুলে দেন। আমি কিশোরগঞ্জে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দেখি ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বারসহ অপহরণকারী ও তাঁর স্বজনরা সেখানে। তখন তারা আমাকে প্রথমে মেম্বারের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাঁরা সবাই আমাকে নিয়ে আমার বাড়ির দিকে রওনা দেন।’

কিশোরী বলেন, ‘তখন ধর্ষকদের একজনের মা, বাবা ও ভাই আমাকে বলে, তুই বড়িতে গিয়ে বলবি আমি নিজ ইচ্ছায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছি। যদি না বলিস, তা হলে শুধু লাশ দেখতে পাবি। আমি শুধু বাড়িতে যাওয়ার জন্য তাঁদের কথায় সায় দিই। বাড়িতে যাওয়া মাত্রই আমি আমার পরিবারের কাছে সব কথা খুলে বলি। তখন তাঁরা পুলিশকে জানায় এবং আমাকে কিশোরগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখান থেকে মঙ্গলবার আমাকে বিকেলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখানকার চিকিৎসকরা আমার সব কিছু শুনেছেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।’

কিশোরী বলেন, ‘ঝালমুড়ি বিক্রেতা আপুর স্বামী ছাড়া বাকি দুজন আগে থেকেই আমাকে উত্ত্যক্ত করত। আমাকে বিয়ে করতে চাইত। সে বিষয়ে আমি বাড়িতে জানালে তাঁদের অভিভাবককে বলে। তবুও তাঁরা আমার পিছু ছাড়েনি। মুলত ঝালমুড়ি বিক্রেতা আপু ও তাঁর স্বামীর সহযোগিতায় ওরা আমাকে সবাই মিলে ধর্ষণ করেছে। আমি এদের সবার ফাঁসি চাই।’

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. ফিরোজ মিয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সেক্সুয়াল অ্যাসোল্ড নিয়ে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ হাসপাতাল থেকে মঙ্গলবার বিকেলে ওই কিশোরী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। প্রথমে তাকে গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা ও চিকিৎসাপত্র দেওয়া হয়েছে। এরপর তাকে হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে নেওয়া হয়েছে। সেখানে তাকে উন্নত চিকিৎসা এবং  সকল ধরনের আইনি সহযোগিতা দেওয়া হবে।’ 

হাসপাতালে আসা কিশোরীর দাদি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ওরা তিন জন মিলে আমার নাতিকে শেষ করে দিল। এখন আমি আমার এই নাতনিকে কোথায় বিয়ে দেব। আমি ওদের ফাঁসি চাই।’

হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কিশোরীর দাদা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা খুব গরিব। আমার ছেলেটাকে দুজনে ধরে নিয়ে হাঁটাচলা করতে হয়। এখন ওর মেয়েটার এই সর্বনাশ করল ওরা। ওদের ফাঁসির দাবি জানাই।’

ওই কিশোরী জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের তিন জনই বিবাহিত। এরমধ্যে দুজন ট্রলি চালক।  

এ ব্যাপারে কিশোরীর পিতা জানান, ঘটনার পরপরই আমি অভিযোগ দায়ের করেছি। কিন্তু, আমার মেয়েকে পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। আমার মেয়েকে মেম্বার-চেয়ারম্যান বাড়িতে দিয়ে গেছেন। আমার স্ত্রী মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে থানায় গিয়েছিল।

এদিকে মঙ্গলবার রাত ৯টায় নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাজিব কুমার দাস এনটিভি অনলাইনকে জানান, একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

তবে, যাদের বিরুদ্ধে এ সব অভিযোগ তোলা হয়েছে, এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।