নদীর সঙ্গে সুখ-দুঃখের মিতালি

Looks like you've blocked notifications!
ভেলা বানিয়ে ঘুরে বেড়ানো যেন প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞ নদীপাড়ের শিশুদের। এমন করেই ওদের দুরন্তপনার সাক্ষী হয় নদী। ছবিটি বরগুনার খাকদোন নদী থেকে তোলা। ছবি : লেখক

প্রাকৃতিক বৈরিতা, ঝড়-বন্যা আর বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় ওদের। নদী থেকে ধেয়ে আসা দুর্যোগ-দুর্বিপাকগুলো নিত্যদিনের সঙ্গী। নদী ওদের নিঃস্ব করে, তবু নদীকেই ভালোবাসে ওরা। ওদের দেখা মেলে উপকূলের নদী তীরের গ্রামগুলোতে।

সকাল থেকে গোধূলী অবধি দুরন্তপনার সাক্ষী হয় নদী। নদীতে বরশি কিংবা জাল ফেলা, মাছ ধরা, নৌকায় চড়া, কলা গাছের ভেলা বানিয়ে ঘুরে বেড়ানো ওদের প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞ। বিশুদ্ধ অক্সিজেন থেকে বেঁচে থাকার সব খোড়াক মেলে নদী থেকে। নদীর সঙ্গে ওদের যেমন প্রেম, বেঁচে থাকার লড়াইও সেই নদীর সঙ্গেই। মাতৃরূপের নদী কখনো কখনো ঢেউয়ের বিধ্বংসী রূপ নিয়ে রাক্ষুসী হয়ে ওঠে। উদ্বাস্তুতে পরিণত করে দূরে ঠেলে দেয় নদী পাড়ের জনপদকে। যতদিন নদী ওদের আগলে রাখে, ততদিন ওদের দেখা মিলবে নদীর তীরে। যেদিন ভাঙনের নির্দয় থাবা সব কিছু কেড়ে নেবে, তারপর থেকে ওদের আশ্রয় মেলে কোনো শহুরে বস্তির নতুন পরিবেশে। এমন জীবন উপকূলীয় নদীর পাড়ের শিশুদের।

সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি নদীর সঙ্গে ওদের সময় কাটে। ছবিটি বরগুনার বিষখালী নদী থেকে তোলা। ছবি : লেখক

স্মৃতি বিজড়িত জন্মস্থান, নিজ হাতে লাগানো ফুল-ফলের গাছ, পোষা প্রাণী, বাবা-দাদা কিংবা স্বজনের কবর পর্যন্ত গ্রাস করে নদী। ভাঙনের ফলে ভেঙে যায় সাজানো ঘর-গৃহস্থলী। এরপর আর ওদের খোঁজ মেলে না। জন্ম থেকে যে নদী হয় বন্ধুত্বের সঙ্গী, সেই নদী ছেড়ে দূরে যেতে মন চায় না ওদের। জন্মভিটের মায়ায় ওরা নদীর কাছে থাকতে চায়। তবে শেষমেষ যেতে হয় নতুন গন্তব্যেই। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেশান্তরী হয় শিশুরাও।ভাঙন ওদের থেকে শুধু বাসস্থানই কেড়ে নেয় না, শিশুদের জীবন থেকে ভালোবাসার বিদ্যালয়ও হারিয়ে যায়। নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ছোটবেলার বন্ধুত্বও ভেঙে যায়। এমন করেই গৃহহারা শিশুরা হারিয়ে ফেলে বেড়ে ওঠার পরিবেশ। উপকূলীয় জনপদের লক্ষাধিক পরিবারে প্রতিনিয়ত ভাঙন আতঙ্ক নিত্যসঙ্গী করেই দিন কাটায়। পরিবারের সেই দুশ্চিন্তার অংশীদার হতে হয় শিশুদেরও।

বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া মেঘনাপাড়ের একটি ঝুপড়ি ঘরে পরিবারের সঙ্গে থাকে শিশু রাকিব (১৪)। এর আগে এ গ্রামেই তার জন্মভিটা ছিল। অথচ এখন তা কেবল স্মৃতি। রাকিব বলে, ‘আমাদের বাড়ির কাছে প্রাইমেরি স্কুল ছিল, কত বন্ধু ছিল, সবাই বিকালে খেলতাম। কিন্তু ভাঙনে ঘর, স্কুল সব গেছে নদীতে। ছোটবেলা থেকে এমন করে তিনবার ভাঙনের মুখে পড়ছি। জমিজমা নেই বলে আর ঘরবাড়ি করা হয়নি। পরে আর লেখাপড়াও করতে ইচ্ছা করে নাই।’

এমন করেই নদী ভাঙনের ফলে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়ে শিশুরা। বারবার পরিবর্তন করতে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার ফলে পাঠ অভ্যস্ততায় আসে বাধ্যগত পরিবর্তন। শেষমেষ ঝরে পড়ছে শিক্ষা থেকে। এ ছাড়াও পরিবেশ ও পরিচিত গণ্ডি পরিবর্তন, পারিবারিক দরিদ্রতা, স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্নতাসহ নানা কারণে নিজস্ব বাস্তুসংস্থান থেকে ছিটকে পড়তে হচ্ছে শিশুদের। ফলে ভেঙে যাচ্ছে শিশুদের মানসিকতা। পরিবর্তন ঘটছে স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনার। ভাঙনের কারণে উপকূলীয় মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয় না। তাই পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যবঞ্চিত এসব শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে।

নদী ওদের খেলার সাথী, তাই নদীর সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। ছবিটি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা থেকে তোলা। ছবি : লেখক

ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল আউয়াল (৭০)। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাক্ষী হয়েছেন অনেক দৃশ্যপটের। পাশের সুগন্ধা ও বিষখালী নদী ভাঙনের শত স্মৃতির বিবরণ দিতে দিতে তিনি বলেন, ‘খড়-কুটোর ঘর, গবাদি পশু, চাষের জমি, এমনকি পরিবার ও জীবনসহ সবকিছুই বিপদের মুখে রেখে বসবাস করতে হয় নদীর তীরের মানুষদের। কত ঝড়-বন্যা আর ভাঙন আমাদের নিত্যসঙ্গী। ভাঙনে ধরা গ্রামের মানুষগুলোর বারবার বসত পাল্টাতে হয়। এমনিতেই গরিব, তার ওপর আবার বসতভিটা, চাষের জমি, থাকার ঘরও খোয়া যায় ভাঙনে। তাই অভাব কাটে না। এমন পরিবারের শিশুদের কি লেখাপড়া, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব?’

২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন বলছে, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ শিশু। মোট শিশুর মধ্যে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসের কারণে বিপদাপন্ন অবস্থায় আছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৪৫ লাখ শিশু ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকির মধ্যে নদী তীরের ভঙ্গুর ও বিপদজনক বাসগৃহে বসবাস করে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. এ. এইচ. এম. সা’দৎ বলেন, ‘নদী ভাঙনের ফলে শিশুরা তাদের বসবাসে অভ্যস্ত পরিবেশ হারাচ্ছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো শিশুদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। একটি শিশু যখন নিজের নিরাপত্তা বিষয়ে সন্দিহান হয়, তখন সে কোনো নীতিকথা শুনবে না। এমন অবস্থায় তাকে যদি আদর্শিক শিক্ষা দেওয়া হয়, খারাপ-ভালোর পার্থক্য বোঝানো হয় তবে সে তা মানবে না। এমন পরিস্থিতিতে শিশুরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাঁটবে। এই অনিশ্চয়তা থেকেই সে সমাজের খারাপ দিকে প্রভাবিত হবে। ফলে অসামাজিক কার্যকলাপে শিশুদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসিক অবসাদ থেকে নেশায় অভ্যস্ততা, অপরাধ চক্রে জড়িয়ে যাওয়াসহ নানা সামাজিক সমস্যা বেড়েই চলছে।’

শিশুদের প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানিয়ে এ. এইচ. এম. সা’দৎ বলেন, ‘যেহেতু শিশুরা তার নিজ পরিবার ব্যতীত স্বাভাবিক থাকতে পারে না, তাই শিশুদের পরিবারকে সুরক্ষিত করার মাধ্যমেই শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে হবে। শিশুর সামগ্রিক উন্নয়নে তাদের পরিবারের দরিদ্রতা দূর করতে হবে। ভাঙন কবলিত শিশুদের সুরক্ষায় উপকূলের একাধিক স্থানে পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এবং সেসব কেন্দ্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনে কাউন্সেলিং করাসহ শিক্ষা, বিনোদন, খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা হলে ভাঙন কবলিত শিশুদের বিপন্ন ভবিষ্যতের হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।’