নরসিংদীতে উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলির ঘটনায় আটক ৬

Looks like you've blocked notifications!
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খান। ছবি : এনটিভি

নরসিংদীর শিবপুরে বাড়িতে ঢুকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খানকে গুলি করার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। শিবপুর থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ ও ঢাকা মহানগর পুলিশ গতকাল রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দিনগত রাতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে এই ছয়জনকে আটক করে।

আটক হওয়া ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পালপাড়া বাজার রোডের পাশের একটি নির্জন বাড়ি থেকে হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল জব্দ করা করেছে।

আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শিবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদার।

পুলিশের দাবি, ঘটনার নেপথ্যে তিন কোটি টাকার হাট ইজারা। এ নিয়ে বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটতে পারে। এ ঘটনায় এখনো থানায় মামলা করা হয়নি।

স্বজনদের দাবি, চেয়ারম্যানকে গুলির নেপথ্যে সংসদ সদস্য ও তাঁর লোকজনের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতির বিরোধ। তবে দ্রুত রহস্য উদঘাটন করে অপরাধীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ।

গতকাল শনিবার ভোর সোয়া ৬টার দিকে  শিবপুর থানা সংলগ্ন নিজ বাসার ড্রইং রুমে ঢুকে শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খানকে গুলি করেন সন্ত্রাসীরা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে প্রবীণ এই রাজনীতিকের উপর সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে পুরো উপজেলায় থম থমে অবস্থা বিরাজ করছে। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগনেতাসহ সুশীল সমাজের লোকজনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

আটক হওয়া ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার পুটিয়া কামারগাঁও গ্রামের আরিফ সরকার ও মহসিন, আরিফ সরকারের বড় ভাই ফরিদ সরকার (৬৩), সৈয়দনগর গ্রামের সাব্বির (৩২), একই গ্রামের মনসুর আহমেদ রানা (৪৩) ও কামারগাঁয়ের মোমেন মোল্লা  (৫৫) আটক করা হয়।

উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদের ভাতিজা রাব্বি খান জানান, তিনি এখন শংকামুক্ত হলেও আর আগের মতো হাঁটতে পারবেন না। চিকিৎসকরা তাঁদের জানিয়েছেন, তিনি এখন ৭২ ঘণ্টার নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তবে সন্ত্রাসীদের ছোড়া দুটি গুলির মধ্যে একটি তাঁর মেরুদণ্ডতে বিঁধে হাড় ভেঙে গেছে। এই বয়সে এটি আর জোড়া লাগা সম্ভব নয়। যত দিন তিনি বেঁচে থাকবেন তত দিন হুইল চেয়ারে করেই চলাফেরা করতে হবে।

স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদ খানের বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর হয়ে কাজ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। তাঁর বিরোধিতার পরও হারুনুর রশিদ খান চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই তাদের সম্পর্কেও টানাপড়েন চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় টানা ২৫ বছর দায়িত্ব পালন করা হারুনুর রশিদ খানকে। এই ঘটনার জন্যও দায়ী করা হয় স্থানীয় সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভুইয়া মোহনকে।

গুলিবিদ্ধ উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাতিজা জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখার উদ্দিন খান নিপুণ বলেন, ‘যাদের মদদে দল থেকে উপজেলা চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল তাদের মদদেই হারুনুর রশিদ খানকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যাদের নাম আলোচনায় আসছে তারা হলো ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী। তারা অর্থের বিনিময়ে কার নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছে। চাচার তুমুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা ওনার বড় ভাই কিরণ খানের মতো ওনাকেও হত্যা করতে চেয়েছে।’

তবে পুলিশের বিভিন্ন সূত্র জানায়, উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করার ঘটনায় সিসি টিভির ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এরই মধ্যে তিন জনকে শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পুলিশের দাবি, স্থানীয় হাটের ইজারা নিয়ে বিবাদে গতকালের এ ঘটনা ঘটে। দেশের অন্যতম বড় গরুর হাট শিবপুরের পুটিয়া চলতি বছর তিন কোটি টাকার ইজারা নিয়ে এ বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে।

নেতাকর্মীরা জানায়, শিবপুরে অস্ত্রের মহড়া নতুন নয়। গত বছরের ২২ এপ্রিল ইটাখোলা স্থানীয় সংসদ সদস্যের অফিসে এক শালিস দরবারে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়। গত বছরের ৬ নভেম্বর শিবপুর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের উত্তর পাশে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয় সন্ত্রাসীরা। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি শিবপুর বাসস্ট্যান্ডে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনায় ফাঁকা গুলি ছুড়ে সন্ত্রাসীরা। এর চার দিন পর ৩১ জানুয়ারি সদর রোডে অস্ত্রের মহড়া দেয় সন্ত্রাসীরা। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ গতকাল সকালে উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা।

একের পর এক অস্ত্রের মহড়া হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি থানা পুলিশ—এমন অভিযোগ করেন শ্রমিক লীগনেতা আখিল মৃধা। তিনি বলেন, প্রশাসন যদি আগের ঘটনাগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করত তাহলে উপজেলাচেয়ারম্যানকে গুলির ঘটনা ঘটত না। সন্ত্রাসীদের যারা পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে তাদের মদদেই উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুল কবীর খোকন বলেন, ‘গতকাল খবর পেয়েই ছুটে যাই ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে। আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ সদা হাস্যোজ্জ্বল বর্ষীয়ান রজনীতিক হারুনুর রশিদ খানকে দেখে খুব কষ্ট লেগেছে। এ ঘটনার দ্রুত বিচার হওয়া দরকার। নইলে নরসিংদীতে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই।’

খায়রুল কবীর খোকন আরও বলেন, চলতি মাসে রায়পুরা থেকে আসার পথে দিন-দুপুরে তিনিও প্রকাশ্যে শিবপুরের ইটাখোলায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। অথচ এ ঘটনায় পুলিশ তাঁর লিখিত অভিযোগও আমলে নেয়নি এবং কাউকে গ্রেপ্তারও করেনি।

জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘দল ক্ষমতায় অথচ আমরা গুলিবিদ্ধ হই।’

শিবপুর থেকে চিরতরে এই অপরাজনীতি দূর করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তা চাঁদের আলোর মতো পরিষ্কার। আমরা চাই পুলিশ তাদের আটক করে আইনের আওতায় আনুক।’

শিবপুর থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে শিবপুর থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ ও ঢাকা মহানগর পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের যৌথ প্রচেষ্টায় বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত থানায় অভিযোগ করা হয়নি। আমরা আহত উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি সুস্থ হয়ে লিখিত অভিযোগ করবেন। তা ছাড়া এ বিষয়টি নিয়ে জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন  কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানাবেন।’

এদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খানকেসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড সংসদ।

আজ সকালে  উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে এই বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়। এ সময় অতি দ্রুত সন্ত্রাসীদের চিহ্নত করে আইনের আওতায় আনাসহ এরূপ হামলার তীব্র নিন্দা জানান বক্তারা।