নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলার চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষা !

Looks like you've blocked notifications!
নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন। ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ঘটনার আট বছর পার করছে আজ (২৭ এপ্রিল)। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায়ের পর চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। বিচারিক আদালতে ২৬  জনকে মৃত্যুদণ্ড ও হাইকোর্টে ১৫ জনের ফাঁসি বহাল রাখা হয়। তবে আপিল বিভাগে এ ১৫ জনের চূড়ান্ত রায় নিস্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।    

এর আগে ২০১৮ সালে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। এরপর তিন বছর পেরোলেও এই আপিল শুনানি এখনো শুরু হয়নি। এই মামলায়  হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা আসামিদের মধ্যে রয়েছেন র‍্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা ও সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা নূর হোসেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে হাজিরা শেষে প্রাইভেটকারযোগে ফিরছিলেন নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম। একইসময়ে আদালতের কার্যক্রম শেষে অপর একটি প্রাইভেটকারে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম। পথিমধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সাদা পোশাক পরিহিত র‌্যাব সদস্যরা তাদের ৭ জনকেই অপহরণ করেন।

সাত জনকে অপহরণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ। দফায় দফায় চলতে থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

সাতজনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একই পন্থা ও কায়দা অবলম্বন করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবাইকে একই স্টাইলে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। যাতে করে মরদেহ ভেসে উঠতে না পারে। উদ্ধার করা মরদেহগুলো হাত-পা বাঁধা ছিল, পেটে ছিল ফাঁড়া। ১২টি করে ইট ভর্তি সিমেন্টের দুটি বস্তা বেঁধে দেওয়া হয় প্রতিটি মরদেহের সঙ্গে। মরদেহগুলো মুখ ছিল ডাবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো।

মামলা চলাকালে প্রধান আসামিকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামিদের চোখ রাঙানি, নরঘাতকদের পক্ষে আদালতপাড়ায় শোডাউনসহ নানা ঘটনায় গেলো পৌনে তিন বছর ধরেই আলোচিত ছিল ৭ খুনের মামলাটি। তদন্ত শেষে প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ।

ওই বছরের ১৩ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। দুটি মামলায় নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ মোট ২৩ জন কারাগারে আটক রয়েছেন। আর চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে এখনো ১২ জন পলাতক।

২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুটি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। দুটি মামলাতেই অভিন্ন সাক্ষী ১২৭ জন। এর মধ্যে দুটি মামলার বাদী, দুজন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১০৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানো এবং তাদের বক্তব্য গ্রহণের কার্যক্রম। ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। গত ৩০ নভেম্বর শেষ হয় আলোচিত ৭ খুন মামলার আইনি কার্যক্রম।

২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ৪ মিনিট থেকে ১০টা ৯ মিনিট পর্যন্ত তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন আলোচিত ৭ খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নাসিকের বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাবের চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ অধিনায়ক মেজর (অব) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প ইনচার্জ লে. কমান্ডার (অব) এম এম রানাসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেন বিচারিক আদালত। বাকি ৯ জনের মধ্যে অপহরণ ও মরদেহ গুমের সঙ্গে জড়িত থাকায় এক আসামিকে ১৭ বছর, অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬ জনকে ১০ বছর এবং মরদেহ গুমে জড়িত থাকায় ২ জনকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র‌্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

সাত খুনের মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান জানান, সরকার শুরু থেকে মামলাটি নিয়ে নানা টালবাহানা করছে। এটি সরকারের সদিচ্ছায় দ্রুত নিস্পত্তি করে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তসহ সবার রায় দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। এ রায় বাস্তবায়ন না হলে অপরাধীরা অপরাধ করতে আরও উৎসাহিত হবে। তাই দ্রুত এ রায় বাস্তবায়নের দাবি করছি।  

হাইকোর্টে ফাঁসির ১৫ আসামি

হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো প্রধান আসামি নূর হোসেন, র‌্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা (এমএম রানা), হাবিলদার এমদাদুল হক, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী (পলাতক), সৈনিক আলামিন শরিফ (পলাতক) ও সৈনিক তাজুল ইসলাম (পলাতক)।

যাবজ্জীবন ১১ জনের

১১ জনকে ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড দিলেও ২২ আগস্ট হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। তারা হলো র‌্যাবের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহমত আলী, আবুল বাশার, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম, জামালউদ্দিন, এনামুল কবীর, সানাউল্লাহ সানা (পলাতক), শাহজাহান (পলাতক)।

কারাদণ্ড ৯ জনের

এর আগে ১৬ জানুয়ারি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করে যাদের রায় ২২ আগস্ট হাইকোর্ট বহাল রেখেছে। অপহরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে করপোরাল রুহুল আমিনের ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমানের ৭ বছর, হাবিলদার নাসির উদ্দিনের ৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদের ১০ বছর, সৈনিক নুরুজ্জামানের ১০ বছর, কনস্টেবল বাবুল হাসানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, কামাল হোসেনের ১০ বছর ও মোখলেসুর রহমানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। হাইকোর্ট তাদের নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছে।

সেই ৭ খুন : যেভাবে অপহরণ ও হত্যা

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার এবং তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন। ৩০ এপ্রিল বিকেলে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জন এবং ১ মে সকালে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল। পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি মরদেহের সঙ্গে ইটভর্তি দুটি করে বস্তা বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।