পুলিশ কর্মকর্তা বাবার বিরুদ্ধে মাকে আত্মহত্যায় বাধ্য করার অভিযোগ

Looks like you've blocked notifications!
অভিযুক্ত বাবা রাজশাহী মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার নুরুল ইসলাম। ছবি : সংগৃহীত

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ফলে তার স্ত্রী নাজমা ইসলাম আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি করেছেন এই দম্পতির দুই সন্তান। আত্মহত্যার আগেও নাজমা ইসলাম শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পুলিশ শুরু থেকেই এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

নিহত দম্পতির বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অধ্যয়নরত ছেলে নাফিজ ইসলাম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ অভিযোগ করেছেন।

বাবা নুরুল ইসলামের অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ও দীর্ঘদিন ধরে চালানো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে মা নাজমা ইসলাম আত্মহত্যা করেছেন দাবি করে ঘটনার তিন মাস পর গত সোমবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ছেলে নাফিজ ইসলাম। এ ঘটনায় শুরু থেকেই পুলিশ মামলা না নিয়ে ঘোরাচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁর। ফেসবুক স্ট্যাটাসের তিনি তাঁর মায়ের হাতের লেখা সুইসাইড নোট ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ছবিও জুড়ে দিয়েছেন।

নুরুল ইসলামের মেয়ে তাবাসুম ফারজানাও একই দাবি করে বলেন, তাঁর ভাই নাফিজ ইসলাম ফেসবুকে যা লিখেছেন তার পুরোটাই সত্য। ঘটনার পর পরই তাঁরা মামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার কারণে মামলা করতে পারেননি। তাঁরা মায়ের মৃত্যুর বিচার চান।

উল্লেখ্য, গত ৩০ মে বিকেলে রাজশাহী নগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকার নিজ বাড়ি থেকে নাজমা ইসলামের (৫৭) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নাজমার স্বামী নুরুল ইসলাম রাজশাহী মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার। নাজমা ইসলামের মরদেহ উদ্ধারের পর নুরুল ইসলাম দাবি করেন, তাঁর স্ত্রী সিলিং ফ্যান ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। তবে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেনি। তার আগেই নুরুল ইসলাম তার পরিচিতজনদের সহায়তায় মরদেহ সিলিং ফ্যান থেকে নামান। এ ঘটনায় নগরীর চন্দ্রিমা থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। 

নাফিজ ইসলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষে অধ্যয়নরত। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মা-বাবার সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। ছোটখাটো বিষয়ে মায়ের ওপর টর্চার করতেন বাবা। আমার মা সব সহ্য করেই ৩৫-৩৬ বছর সংসার করে গেছেন দুই ছেলেমেয়ের কথা চিন্তা করে। অবসরের পর শুরু হয় বাবার এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার আর মায়ের প্রতি অমানুষিক হিংস্রতা।’

অভিযুক্ত বাবা রাজশাহী মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার নুরুল ইসলামের স্ত্রীর সুইসাইড নোট। ছবি : সংগৃহীত

নাজমা ইসলামের আত্মহত্যার পর থেকেই পুলিশ অসহযোগিতা করে আসছে দাবি করে নাফিজ ইসলাম লেখেন, “৩০ মে ক্লাসে থাকাকালে ফোনে আমি জানতে পারি, আমার মা আর বেঁচে নেই। নিজেকে সামলে দ্রুত রাজশাহীতে আসি। আমার আসার আগেই রাজশাহী চন্দ্রিমা থানার পুলিশ উপস্থিত হয় বাসায়। চন্দ্রিমা থানার অফিসার ইনচার্জ এমরান হোসেন এরপর শুরু করলেন আরেক খেলা। আমার মায়ের শরীরের আঘাতের চিহ্নগুলো মৃত্যুর পর শুইয়ে রাখার জন্য হয়েছে, এ রকম বলতে থাকেন। পুলিশের প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্টেও সে রকমই লেখা হলো। রাত ৮টার দিকে মাকে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হলো। এরপর মায়ের লেখা সুইসাইড নোট খুঁজে পাই আমার মায়ের ড্রয়ারে, যেখানে মা স্পষ্ট লিখে গেছেন, তাঁর সঙ্গে কী কী করা হয়েছিল। রাতেই থানায় যোগাযোগ করি অভিযোগের জন্য। ওসি এমরান হোসেন নোট দেখে বলেন, ‘এসব অভিযোগ লাগবে না, অপমৃত্যু মামলার তদন্তেই সব বেরিয়ে আসবে।’

নাফিজের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবা প্রভাব খাটিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে নিচ্ছেন অভিযোগ করে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমার মায়ের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এক মাস পর পাওয়া গেল। প্রতিবেদনে মায়ের শরীরে মারধরের চিহ্ন স্পষ্ট। এরপর থানা থেকে আমাকে বলা হয়, পুলিশ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পায়নি। এদিকে আমার বাবা ফোনে আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। রাজশাহীতে গেলে আমাকে কেটে ফেলবেন। পরে আমার মা মারা যাওয়ার তিন মাস পর থানা-পুলিশ স্বীকার করল, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। কিন্তু তাদের কিছু করার নেই।’

নাফিজ ইসলামের ফেসবুক স্ট্যাটাসের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর একমাত্র বোন তাবাসসুম ফারজানা বলেন, তাঁর ভাই ফেসবুকে যা লিখেছেন, এর পুরোটাই সত্য। তাঁরা মামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার কারণে মামলা করতে পারেননি। তাঁরা এ ঘটনায় বিচার চান।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার নুরুল ইসলামের স্ত্রীর লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। ছবি : সংগৃহীত

নাফিজ ইসলাম জানান, তাঁর মায়ের সঙ্গে যা যা ঘটেছে, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তিনি এ ঘটনায় মামলা করতে চান। শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে চান।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। চন্দ্রিমা থানার ওসি এমরান হোসেনকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চন্দ্রিমা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাইনুল বাশার বলেন, ওসি স্যার বর্তমানে একটি প্রশিক্ষণে আছেন। এটা নিয়ে তিনি রাজপাড়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) সোহেল রানাকে কল করার পরামর্শ দেন।

এসি সোহেল রানা মুঠোফোনে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ‘ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট’ কিছুটা পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে নাফিজের সঙ্গেও তাঁদের কথা হয়েছে। একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হলেই সেটি অন্য মামলায় রূপান্তরিত হবে।