পেঁয়াজের বীজ চাষে কোটিপতি শাহিদার গল্প

Looks like you've blocked notifications!
এনটিভির প্রতিবেদকের সঙ্গে নিজের পেঁয়াজ ক্ষেতে ফরিদপুর সদর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের চাষি শাহিদা বেগম। ছবি : এনটিভি

গত ১৮ বছর ধরে পেঁয়াজের বীজ চাষ করছেন দেশসেরা নারী কৃষক ফরিদপুর সদর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের পেঁয়াজচাষি শাহিদা বেগম। পেঁয়াজের বীজ চাষ করে আত্মনির্ভরশীল শুধু নয়, স্থাপন করেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত।

দেশের মোট চাহিদার পেঁয়াজ বীজের চার ভাগের এক ভাগ আসে শাহিদার উৎপাদিত ‘খান বীজ’ থেকে। গত বছর তাঁর চাষ করা ২০০ মণ পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন চার কোটি টাকা। এরই মধ্যে তিনি এ বছর সেরা নারী কৃষক হিসেবে পেয়েছেন ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড চ্যানেল আই এগ্রো অ্যাওয়ার্ড’। এছাড়া তিনি ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিএডিসির চুক্তিবদ্ধ কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। পেঁয়াজ ও পেঁয়াজ বীজ চাষ করে পেয়েছেন বহু পুরস্কার। 

শাহিদা বেগম গত ১৮ থেকে ১৯ বছর ধরে পেঁয়াজের বীজের আবাদ করে চলেছেন। আর চলতি বছর প্রায় ২০০ মণ পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করেছেন তিনি। মৌসুমে এই বীজ মণপ্রতি দুই লাখ টাকা করে বিক্রি করেছেন।

জানা গেছে, চলতি মৌসুমে পেঁয়াজের বীজ বিক্রি হয়েছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা কেজি দরে। এ বছর এরই মধ্যে বীজ উৎপাদনের জন্য যে পেঁয়াজ লাগানো হয়েছিল তার ফলন আসবে আগামী এপ্রিল-মে মাসে।

দেশসেরা নারী চাষি শাহিদা বেগম বলেন, ‘কৃষক পরিবারের বউ হওয়ার কারণে আগে থেকেই কৃষিকাজের সঙ্গে পরিচয় ছিল আমার। শ্বশুর মূলত পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু কখনোই বেশি পরিসরে চাষ করা হয়নি। আমি নিজেও অনেকটা শখের বশেই পেঁয়াজ চাষ শুরু করি। আশপাশের কেউ কেউ খুব কম করে পেঁয়াজের বীজ চাষ করত। আমারো মনে হলো আমি করে দেখি, তাই করলাম।’

শাহিদা বেগম বলেন, ‘২০০৪ সালে দ্বিতীয় সন্তান জন্মের আগে ২০ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজের বীজ চাষ করি। সে বছর মাত্র দুই মণ বীজ উৎপাদন হয়েছিল। সেগুলো বিক্রি করে পেয়েছিলাম ৮০ হাজার টাকা। পরের বছর আরও বেশি পরিমাণ জমিতে পেঁয়াজের চাষ করতে শুরু করি। সে বছর পেয়েছি ১৩ মণ বীজ।’

ক্রমান্বয়ে চাষি হয়ে ওঠার গল্প বলেন শাহিদা। তিনি বলেন, ‘বীজ বিক্রি করে দেখলাম যে আমি ভালেই লাভবান হচ্ছি। পরের বছর আরও জমি বাড়াই। ৩২ মণ বীজ উঠল। এভাবেই আমার সফল চাষি হয়ে ওঠা।’

কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিজের পেঁয়াজ ক্ষেতে ফরিদপুর সদর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের চাষি শাহিদা বেগম। ছবি : এনটিভি

এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি সাহেদাকে। গত বছর ৩০ একর জমিতে পেঁয়াজের বীজের চাষ করেছিলেন। ঘরে তুলেছিলেন ২০০ মণ বীজ। আর এবার করেছেন মোট ৩৫ একরের উপরে জমিতে পেঁয়াজ বীজের চাষ।

‘অনেক শ্রম দিতে হয়, কষ্ট করতে হয়। পেঁয়াজের বীজের জন্য অনেক যত্ন করতে হয়। তবে আমার এই যাত্রা সহজ ছিল’ সেই বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন অবলীলায়।

ফরিদপুর জেলার স্থানীয় কৃষক তো বটেই, পুরো বাংলাদেশে তারা বীজ সরবরাহ করে থাকেন তিনি। শাহেদা বলেন, ‘আমাদের বীজ ভালো বলে চাহিদা থাকে। কৃষকরা অনেক খুশি। কারণ এর মধ্যে কোনো ঝামেলা নাই। নিজের প্রোডাক্ট, কোনো ভেজাল নাই।’

শাহিদা বেগমের পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের কাজে সহায়তা করেন তাঁর স্বামী বক্তার উদ্দিন খানও। তিনি চাকরি করেন সোনালী ব্যাংকে। সাহিদা বেগম নিজেই গড়ে তুলেছেন পেঁয়াজের বীজের কারখানা। সেখান থেকেই বীজ প্যাকেটজাত করা এবং ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করা হয়। তাঁর উৎপাদিত বীজ ক্রেতাদের কাছে পরিচিত ‘খান বীজ’ নামে।

শাহেদা বেগমের উৎপাদিত পেঁয়াজ বীজ হলো তাহেরপুরী, সুখ সাগর, নাসিক কিং, বারী-১, বারী-৪, বারী-৫।

স্থানীয় কৃষক আলমাস সেখ বলেন, ‘আমরা আগে অন্য ফসল চাষ করতাম এখন পেঁয়াজ বীজ চাষ করি। শাহেদা বেগম যেভাবে এলাকায় পেঁয়াজ চাষ করছেন সেটা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েই আমাদের এই চাষে আসা। এখন ভালো লাভ পাচ্ছি। দিনকে দিন আমারও চাষের এলাকা বাড়ছে।’

অন্য এক কৃষক সুমন জোমাদ্দার বলেন, ‘শাহেদা বেগম শুধু পরিবর্তন করেননি। পেঁয়াজ চাষে তাঁর সফলতা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমরা তাঁর দেখাদেখি এখন অধিক পরিমাণ জমিতে পেঁয়াজ ও পেঁয়াজ বীজের চাষ শুরু করেছি। আগে ছিল টিনের ঘর এখন আমার বাড়িতে বিল্ডিং হয়েছে। এভাবে যদি পেঁয়াজ বীজের চাষ করতে পারি তাহলে সামনের দিনে দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি থাকবে না।’ 

মানিকগঞ্জ থেকে আসা বীজ ব্যবসায়ী রইচ মেম্বার জানান, ‘আমি এই বীজের ব্যবসা করছি অনেক বছর। এই ফরিদপুর থেকেই বীজ কিনে নিয়ে ব্যবসা করতাম। তখন এমন বিপ্লব দেখিনি। শাহেদা বেগম বীজ চাষে আসার পর থেকে এই চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। সারা দেশে তাঁর মতো এতবড় পেঁয়াজ বীজ চাষি আর নেই। যে কিনা একাই চাষ করেন একশ থেকে দেড়শো বিঘা জমিতে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি পেঁয়াজ বীজ চাষ করতে। সেখানে সর্বোচ্চ একজন কৃষক চাষ করে দশ বিঘা বা বিশ বিঘা জমিতে। কিন্তু একজন নারী পেঁয়াজ বীজ চাষি একশ থেকে দেড়শো বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বীজের চাষ করেন যা সারা দেশ তো বটেই সারা বিশ্বের কোথাও নেই। তিনি আমাদের গর্ব। সামনের দিনে এই শাহেদা বেগমের ভূমিকার কারণেই পেঁয়াজের যে খাটতি রয়েছে দেশে তা দূর হবে বলে আমি মনে করি।’

ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. হজরত আলী বলেন, ‘সত্যি বলছি পেঁয়াজ ও পেঁয়াজ বীজের চাষে সাহেদা বেগম একটি নাম নয়, শুধু একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর পেঁয়াজ ও বীজের কারণে সামনের দিনে দেশে পেঁয়াজের যে খাটতি রয়েছে তা আর থাকবে না বলে মনে করা হচ্ছে। আর এই কারণে ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পেঁয়াজ বীজ আবাদে মাঠ পর্যায়ে শাহিদা বেগমসহ সব কৃষক সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।’

কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিজের পেঁয়াজ ক্ষেতে ফরিদপুর সদর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের চাষি শাহিদা বেগম। ছবি : এনটিভি

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সাহেদা বেগমের পেঁয়াজ বীজের মান অনেক ভালো। বাংলাদেশে পেঁয়াজ বীজের যে খাটতি ছিল এই সব চাষিদের কারণে বিদেশ থেকে আর পেঁয়াজ বীজ আমাদের আনতে হচ্ছে না।’  

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, ‘ফরিদপুরের সদর উপজেলাধীন অম্বিকাপুরের গোবিন্দপুর গ্রামের পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে অসামান্য সাফল্য অর্জনকারী নারী উদ্যোক্তা শাহিদা বেগমের কৃষি খামার। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রবর্তিত কৃষি প্রণোদনার ওপর ভর করে এ ধরনের লাখ লাখ শাহিদার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে আজকের বাংলাদেশ। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করার পরিবর্তে পেঁয়াজ রপ্তানি করতে শুরু করবে। পেঁয়াজ উৎপাদনেও স্বনির্ভর হবে প্রিয় স্বদেশ।’

‘শাহিদা বেগমের পেঁয়াজ বীজ সারা দেশের পেঁয়াজ চাষে যে ভূমিকা রাখছে তা একটি জেলার জন্য গর্বের।’-বলেন জেলা প্রশাসক।  

উল্লেখ্য, ফরিদপুর জেলায় এ বছর এক হাজার ৭১১ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজ চাষ করা হয়েছে। যা থেকে এক হাজার ২৬ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদিত হবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা। যার মধ্যে দেশের মোট চাহিদার পেঁয়াজ বীজের চার ভাগের এক ভাগ বীজ থেকে আসে শাহিদা বেগমের উৎপাদিত ‘খান বীজ’ প্রতিষ্ঠান থেকে।