প্রধান বিচারপতির আত্মীয় খোয়ালেন ১৯ লাখ টাকা!
বিচার চাইতে এসে কোর্টে অহরহ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকে। বাদ যাচ্ছেন না বাদী, কিংবা বিবাদী। এবার এমনই এক ঘটনার শিকার হলেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর এক আত্মীয়। গত বৃহস্পতিবার (১৮ মে) সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে সে কথা তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি।
অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এখানে সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি আছেন। তারা হয়তো অখুশি হতে পারেন। এখন থেকে সাত থেকে আট বছর আগে আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় সার্ভিস ম্যাটারে রিট করার জন্য আমার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। আমি তাকে অ্যাডভাইস করলাম। বললাম দেখ, এই মামলা-মোকাদ্দমা করতে যেও না। এই মামলা করো না। এই মামলাতে তুমি হেরে যাবে। এটা সার্ভিস ম্যাটার। কারণ, বিষয়টি হাইকোর্ট ডিভিশনের এখতিয়ারভূক্ত ছিল না। কিন্তু সে আমাকে না জানিয়ে হাইকোর্টে মোকাদ্দমাটা করে। হাইকোর্ট তার পক্ষে রায়ও দেয়। রুল যথাযথ ঘোষণা হয়। পরে সে আর নকল পায় না। অনেক দিন ঘুরে ঘুরে নকল যখন পাননি, তখন একপর্যায়ে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি তখন দেশের প্রধান বিচারপতি। এর আগে সে যে মামলা করেছে, রুল হয়েছে, কিছুই আমাকে বলেনি। কারণ, আমি তাকে মামলা করতে বারণ করেছিলাম।’
এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সম্প্রতি আমার ব্রাদারদের (সহকর্মী বিচারপতি) কাছে গল্পটা করেছিলাম। পরিস্থিতিটা আপনাদের বোঝানোর জন্য বলছি। আমি তখন প্রধান বিচারপতি। একদিন সেই আত্মীয় আমার বাসায় আসেন। আমি কাজ করছিলাম। বাসায় এসে সেই আত্মীয় দেখি কান্নাকাটি শুরু করেছেন। আমি বললাম, কান্নাকাটি করো কেন? তখন সে বলল, আপনি তো মোকাদ্দমা করতে নিষেধ করেছিলেন। আমি মোকাদ্দমা করেছিলাম, মোকাদ্দমাতে জিতেছিও। কিন্তু দুই বছর হলো মামলার রায়ের কপি এখনও পাইনি। আমি যে অ্যাডভোকেট এনগেজড করেছিলাম, সেই অ্যাডভোকেট সাহেবের ক্লার্ককে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি মামলার নকল ওঠানোর জন্য। কিন্ত সে রায়ের নকল দিতে পারেনি। পরে আরেকজন আইনজীবীর ক্লার্ককে বললাম, তুমি নকলটা তুলে দিতে পারবে? সে বলল খুবই পারি, কিন্তু নকল তুলতে পারেনি। এর মধ্যে ওই ক্লার্ক ৮০ হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এই কেসের পারপাসে মোট কত টাকা খরচ করেছ? সে তখন বলেছে, আমি ল’ইয়ারকে দিয়েছি ১৮ লাখ টাকা। আমি জিজ্ঞেস করলাম ল’ইয়ার সাহেবের নাম কী? একজনের নাম বলল। কিন্তু, সেই আইনজীবীর নাম আমি এর আগে শুনিনি, দেখিওনি। যারা প্র্যাকটিসিং ল’ইয়ার তাদের সবাইকে তো আমার চেনার কথা। আর ১৮ লাখ টাকা যার ফি, তাকে তো চিনবোই। কিন্তু, একে আমি চিনতে পারলাম না। ১৮ লাখ টাকা ল’ইয়ার নিয়েছেন। ৪০ হাজার টাকা তার ক্লার্ক নিয়েছে নকল তোলার জন্য। পরবর্তীতে নকল ওঠানোর জন্য আরেকজন ক্লার্ককে ধরেছে। সে আবার ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে, কিন্তু মামলার নকল পাননি।’
প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে এই সমস্যাটা কীভাবে সমাধান করব, আপনারা বলেন তো দেখি? এটা সমস্যার একটা উদাহরণ দিলাম। এরকম সমস্যার মধ্যে আশার কথাও আছে।’
এরপর প্রধান বিচারপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যদি আমার কাছে আসে, আমি অন্তত এক মিনিটও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অপেক্ষা করব না। সে যত উচ্চপদস্থ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হোক বা সুপ্রিম কোর্টর এক কর্মচারীই হোক।…কিন্তু যদি কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না আসে, তাহলে কীসের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেব। যখন কারো দুর্নীতি হাতেনাতে ধরা হয়, আমরা সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
আইনজীবীদের প্রতি আহবান জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে যদি দুর্নীতির সঙ্গে কেউ জড়িত হন, কোনো প্রমাণ থেকে, থাকলে আমাদেরকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন। আমরা ব্যবস্থা নিতে পিছপা হব না।’