ফিরে এলো মসলিনের ঐতিহ্য, আংটির ভেতর দিয়ে যায় শাড়ি

Looks like you've blocked notifications!

হারিয়ে যাওয়া ঢাকাইয়া মসলিন ১৭০ বছর পর ফের সরকারের উদ্যোগে ঐতিহ্য ফেরাতে সক্ষম হয়েছে এক দল গবেষক। ৬ বছর গবেষণা শেষে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে উৎপাদন হচ্ছে এই মসলিন। আংটির ভেতর দিয়ে যায় একটি শাড়ি। এ বছরই বিক্রির জন্য বাজারজাত করা হবে ঐতিহ্যবাহী মসলিন শাড়ি। এক একটি শাড়ির উৎপাদন খরচ সাড়ে তিন লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত। সরকারি খাতে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে মসলিন তৈরির প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তাঁত বোর্ড। তারপর পুরোদমে শুরু হবে এই ভৌগলিক নির্দেশক জিআই পণ্যের উৎপাদন।

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের আবহাওয়া ও পরিবেশ মসলিন উৎপাদনের জন্য সেরা। ফুটি কার্পাসের ফুলের তুলা দিয়ে উৎপাদন করা হয় সুতা। চরকা ঘুরিয়ে ফুটি কার্পাস তুলা দিয়ে মসলিনের জন্য তৈরি হচ্ছে বিশেষ সুতা। এক সময়ে ইংরেজরা তিন আঙুল কেটে দিয়েছিল তাঁতীদের। সেই ইতিহাস মনে রেখে নারীরা তাঁদের নিপুণ হাতের তিন আঙুলের ছোঁয়ায় দক্ষতার সাথে তৈরি করছেন সুতা। তাদের তৈরি আড়াই গ্রাম সুতার দৈর্ঘ্য প্রায় ২ কিলোমিটার। এমন সুতা কাটার জন্য থাকতে হবে নিবিড় মনোযোগ। সুতায় তুলা ছাড়তে বাম হাতের তিন আঙুলকে মোলায়েম ও স্বচ্ছ রাখাও যেমন জরুরি; তেমনই থাকতে হবে আবহাওয়া অনুকূলে। এমনটাই জানালেন তাঁতী রুবেল মিয়াসহ বেশ কয়েকজন নারী তাঁতী।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মসলিন উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আইয়ুব আলী এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান, একসময় ইউরোপের বাজারে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই মসলিন পণ্যের যেভাবে আবির্ভাব হয়েছিল, আবার সেভাবেই হঠাৎ হারিয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে। ১৮৫০ সালে লন্ডনে ঢাকাইয়া মসলিনের সর্বশেষ প্রদর্শনী হয়। সেই প্রদর্শনীর ১৭০ বছর পর সরকার উদ্যোগ নিলে নারায়ণগঞ্জের দুজন তাঁতী সেই নকশা দেখে হুবহু একটি মসলিন শাড়ি বুনতে সক্ষম হন ২০২০ সালে। এরমধ্য দিয়ে বিলুপ্ত ইতিহাস আবার ফিরে আসে।

প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আইয়ুব আলী বলেন, ‘মসলিনের একটি শাড়ি বুনতে সময় লাগে ৬ থেকে ৯ মাস। ইতোমধ্যে তাঁতীরা তৈরি করেছেন মসলিনের ৭টিসহ ২৮টি শাড়ি। তার মধ্যে একটি দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। একটি আংটির ভিতর দিয়ে সহজেই গলে যাচ্ছে মসলিন শাড়ি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মসলিন প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০১৪ থেকে এই ৮ বছরে খরচ হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও মসলিন প্রকল্পের সদস্য অধ্যাপক ড. শাহ আলিমুজ্জামান এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, মসলিন গবেষণা ও উৎপাদনের জন্য প্রথম আমাদের টার্গেট ছিল ফুটি কার্পাস গাছ খুঁজে বের করা। তা খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছি। ফুটি কার্পাস থেকে বেশ কয়েকটি জাতের মধ্য থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করা এখন পর্যন্ত আমাদের গবেষণার মধ্যে আছে। পরের ধাপে ফুটি কার্পাস তুলা থেকে সুতা তৈরির চেষ্টা করেছি। কারিগরদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তাঁতীরা প্রথমে আট দশ কাউন্টের সুতা তৈরি করত। এরপর থেকে আমরা প্রায় সাতশ মেট্রিক কাউন্টের সুতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এই সুতা দিয়ে আমরা এখন অরিজিনাল মসলিন তৈরি করছি। এখন এটার সম্ভাবনার দিক অনেক বেশি। কারণ এটা আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের সোনালী যুগের গর্ব মসলিন আমরা যে ফিরিয়ে আনতে পারছি, এটা অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। এটার সামনের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল এবং অর্থনীতির বড় সম্ভাবনার দিক।

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক এমপি এনটিভি অনলাইনকে জানান, সোনালী ঐতিহ্য মসলিন সুতা ও কাপড় তৈরির প্রযুক্তি পুনরুদ্ধারের পর এখন বাজারজাতের মনোযোগ বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তাঁত বোর্ডের। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এক একটি শাড়ির উৎপাদন খরচ সাড়ে তিন লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা। এ বছরই হস্তান্তর করা হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। তাহলে অনেকটা কমে আসবে উৎপাদন খরচ। ব্যাপক গবেষণা ও সঠিক প্রশিক্ষণে ঢাকাইয়া মসলিন হতে পারে আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উৎস।