স্বাধীনতার ৫০ বছর

বাংলাদেশ : তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বিশ্বের বিস্ময়

Looks like you've blocked notifications!

৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়য়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ। এ ৫০ বছরে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক বন্ধুর পথ। কেউ কখনও ছোট করে বলেছে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, কেউ নিয়েছে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সুযোগ। আবার স্বাধীন বাংলার মাটিতে আবার কেউ জঙ্গির বীজও বপন করতে চেয়েছে। কিন্তু, সব কিছু ছাড়িয়ে বাংলাদেশে তার নিজের স্থান করে নিয়েছে বিশ্ব দরবারে। অর্জন করেছে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উঠে আসার মর্যাদা।

অথচ স্বাধীনতার পর যখন মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, তখন দেশে খাদ্যসংকট ছিল। আমদানি করে চলতে হতো। পঞ্চাশ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে ১৭ কোটিতে পৌঁছেছে। এ সময়ে আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে অনেক। অথচ আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

২০২০ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের বিশেষ সংখ্যার ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০২০’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বিশ্বে সর্বাধিক এগিয়ে থাকা শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকার তিন নম্বরে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। সাময়িকীটি বলছে, আগামী অর্থবছরে (২০২০-২১) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৭.৭ শতাংশ। আর শীর্ষ ১০-এর তালিকা থেকে বাদ পড়েছে চীন। ভারতের অবস্থান ১০ নম্বরে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল মাত্র ৫০০ মেগাওয়াট। আর, মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন স্টেশন ও সাবস্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনটিতে মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ হয়েছে ২০০ মেগাওয়াটেরও কম। বিজয়ের ৫০ বছরে এসে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার মেগাওয়াটে।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করে। যা, ২০২১ সালে প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষের ঘরে পৌঁছে গেছে বলে সরকার দাবি করছে। সরকারের দাবি—ভোলার চরকুকরিমুকরি, শরীয়তপুরের চর আত্রা, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে সাবমেরিন কেবল প্রযুক্তির সহায়তা বিদ্যুৎ পৌঁছেছে।

এ ছাড়া আগামী মার্চের মধ্যে ১০০ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হবে বলেও তারা অঙ্গীকারবদ্ধ।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষি বিপ্লব

সবজি

বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটা সম্ভব হয়েছে কৃষি বিপ্লবের কারণেই। পরিসংখ্যানে দেখা যায়—সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ  তৃতীয়। প্রতি বছর এক কোটি ৬০ লাখ টন সবজি উৎপাদন করে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থান চীনের, দ্বিতীয় স্থান ভারতের।

মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ তৃতীয়তে অবস্থান করেছে। এফএও’র তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে দেশের মাছের উৎপাদন ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বের মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ মিঠাপানির মাছ উৎপাদন করে বাংলাদেশ। যেখানে ১৬ শতাংশ নিয়ে প্রথম চীন, ১৪ শতাংশ নিয়ে ভারত দ্বিতীয়।

মাংস ও দুধ

গরু ও ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এফএও’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাগলের সংখ্যা, মাংস ও দুধ উৎপাদনের দিক থেকে বৈশ্বিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দুই দেশ হলো ভারত ও চীন।

আলু

কৃষি ক্ষেত্রে আরেক বিপ্লবের ঘটেছে আলুতে। ১৯৭০ সালে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছিল নয় লাখ টন। ৫০ বছর পর আলু উৎপাদন ১১ গুণ বেড়েছে। বর্তমানে বিশ্বে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ষষ্ঠতে অবস্থান করছে।

কাঁঠাল

বিশ্বে বছরে ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়। এ ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে। বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ১০ লাখ টন। বিশ্বে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টন কাঁঠাল হয় ভারতে। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড।

আম

বাংলাদেশ এখন বিশ্বে আম উৎপাদনে অষ্টম। বছরে উৎপাদন হয় ২৫ লাখ টনের মতো। ১০ বছর আগে ১২ লাখ ৫৫ হাজার টন নিয়ে অবস্থান ছিল দশম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানেও উঠেছিল। আম উৎপাদনে সবার ওপরে ভারত। তাদের উৎপাদনের পরিমাণ দেড় কোটি টন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চীন।

এখন সারা দেশেই আম চাষ হচ্ছে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে একসময় হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া ও ফজলি আমের চাষ বেশি হতো। বর্তমানে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় ব্যাপক হারে হাড়িভাঙা ও আম্রপালির চাষ হচ্ছে।

পেয়ারা

পেয়ারা ১০ লাখ ৪৭ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদন করে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম স্থানে। এক কোটি ৭৬ লাখ টন নিয়ে ভারত প্রথম এবং ৪৪ লাখ টন উৎপাদন করে চীন দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

একসময় শুধু দেশি পেয়ারার চাষ হলেও বিপ্লবটা ঘটিয়েছে থাই জাতের ও কাজি পেয়ারা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে উদ্‌ভাবন হয়েছে ১০ প্রজাতির পেয়ারা। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেই মূলত পেয়ারার চাষ হয়।

পাট

‘সোনালি আঁশ’-খ্যাত পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। তবে, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ। দেশে পাট উৎপাদনের পরিমাণ ১৩ লাখ ৩৫ হাজার টন, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৪২ শতাংশ। প্রায় ২০ লাখ টন উৎপাদন করে প্রথম ভারত। দেশটিতে হয় বিশ্বের উৎপাদনের ৫৫ শতাংশ। ৪৫ হাজার টন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে চীন। এ ছাড়া পাট দিয়ে ২৮৫ ধরনের পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করা হয়।

চা

বাংলাদেশ বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ চা উৎপাদনকারী দেশ। চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬৭টি বাণিজ্যিক চা এস্টেট রয়েছে। এখানকার এ শিল্প বিশ্বের ৩ শতাংশ চা উৎপাদন করে থাকে। বাংলাদেশে চা উৎপাদনের সঙ্গে প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী শ্রমিক যুক্ত।

ইলিশে প্রথম

সারা বিশ্বে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে হচ্ছে, যা পরিমাণে পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার টন। তবে, ইলিশ উৎপাদন সাত লাখ টন হওয়াও সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।

চার বছর আগেও বিশ্বে মোট ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল ৬৫ শতাংশ। ইলিশ উৎপাদনে ভারত দ্বিতীয়, মিয়ানমার তৃতীয়। এ ছাড়া ইরান, ইরাক, কুয়েত, পাকিস্তানেও সামান্য ইলিশ উৎপাদন হয়।

প্রবাসী আয়ে সপ্তম

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি বসবাস করে, যাদের বেশির ভাগই শ্রমিক। এদের বলা হয় রেমিটেন্স যোদ্ধা।১৮ নভেম্বর বিশ্বব্যাংকের অভিবাসন ও উন্নয়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বকলা হয় প্রবাসী আয় আহরণে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ভারত আছে প্রথম স্থানে। এ ক্ষেত্রে চীন আছে দ্বিতীয় অবস্থানে।সপ্তম স্থানে থাকা  বাংলাদেশ বছরের ২৩ বিলিয়ন ডলার আয় করে থাকে।

তৈরি পোশাকে তৃতীয়

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও দ্বিতীয় স্থানে ছিল বাংলাদেশ। করোনার মধ্যে ভিয়েতনামের রপ্তানি হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় গত জুলাইয়ে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে বাংলাদেশ।

আউটসোর্সিংয়ে দ্বিতীয়

তথ্য প্রযুক্তিতেও বাংলাদেশ এগিয়েগেছে সমান তালে।  বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ছয় লাখ, যা শতকরা হারে বিশ্বের প্রায় ২৭ শতাংশ। এর বদৌলতে বাংলাদেশ এ খাতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যায় প্রথম হলো ভারত।

ওষুধ রপ্তানি

বাংলাদেশ ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রয়োজনীয় ওষুধের ৯৮ শতাংশ দেশেই তৈরি হচ্ছে। জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো প্রকাশিত বিজ্ঞান প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশে প্রায় ১৫০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। এ খাতের বাৎসরিক বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকায়।