ভাঙছে মনপুরা, ভাঙছে মন

Looks like you've blocked notifications!
মনপুরায় ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। ছবি : সংগৃহীত

গাছে গাছে পাখিদের কুহুতান, নীরব প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য গড়েছে বাতাস। দৃষ্টির শেষ অবধি সবুজের অপার সৌন্দর্য। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে সাজে দ্বীপ জেলা ভোলার আরেক দ্বীপ মনপুরা। মনপুরা তার রূপের পসরা সাজিয়ে বসলেও ভালো নেই এই দ্বীপের বাসিন্দারা। সব সময় ভাঙন আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় দিন কাটে তাদের। মনপুরার ভাঙনে মন ভেঙে যাচ্ছে তাদের।

ভোলা শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে সাগরের বুকে নয়নাভিরাম বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনপুরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও দ্বীপটিকে খুব পছন্দ করতেন। স্বপ্নের মনপুরায় বঙ্গবন্ধুর ‘চিন্তা নিবাস’ করার স্বপ্ন ছিল। সবুজে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি মনপুরা। যার পরতে পরতে রয়েছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির হরেক গাছ। ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে মনপুরা একটি ভ্রমণস্বর্গ। ২০০৯ সালের সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র ‘মনপুরা’। এই চলচ্চিত্র গ্রামীণ পটভূমির কারণে জনপ্রিয়তা পায়। যদিও এই সিনেমার অধিকাংশ দৃশ্যায়ন মনপুরায় হয়নি। তবু এই ছবির পরে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি পায় এই দ্বীপটি।

ভালো নেই সেই স্বপ্নপুরী মনপুরা। ভাঙনের চোখ রাঙানিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মেঘনা বেষ্টিত এই জনপদ। দিনের পর দিন ভেঙে যাচ্ছে মনপুরা। এ ভাঙন দেখলে মনে হবে ভূমিকম্প এসে সব তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ৩৭৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মনপুরা ভেঙে পৌঁছেছে ২০০ বর্গকিলোমিটারের নিচে। মেঘনার ভাঙনে এরই মধ্যে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে৷ নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি৷ বিলীন হচ্ছে গ্রাম, মসজিদ, মন্দির৷ এ যেন মেঘনার স্রোতের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ।

চারটি ইউনিয়নের দেড় লাখ জনসংখ্যা নিয়ে মনপুরা উপজেলা গঠিত। হাজিরহাট সদরের একটি অংশ ও রামনার মাথা এলাকায় ব্লক ফেলার কারণে কিছুটা ভাঙন রোধ হয়েছে। এ ছাড়া ওই ইউনিয়নের সোনারচর, চরজ্ঞান, দাসের হাট, মনপুরা ইউনিয়নের কুলাগাজীর তালুক, সীতাকুণ্ড, ঈশ্বরগঞ্জ, সাকুচিয়া উত্তর ইউনিয়নের মাস্টারহাট বাজার সংলগ্ন পশ্চিম পাশ, সাকুচিয়া দক্ষিণ ইউনিয়নের রহমানপুর গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে।

স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে এসব বেড়িবাঁধ অনেকটাই ভেঙে গেছে। রামনা, হাজীরহাটে পুরাতন কোনো বেড়িবাঁধ এখন আর টিকে নেই। হাজীরহাট ইউনিয়নের পূর্ব অঞ্চলে ও ফয়জোদ্দির দুইটি ওয়ার্ডে পুরাতন একটি বেড়িবাঁধ এখনও আছে। মোটের উপর ৭৭ কিলোমিটার পুরাতন বেড়িবাঁধের তিনভাগের দুইভাগই বিলীন হয়ে গেছে। বাকি যা আছে তাও ভাঙনের মুখে। মনপুরার ঈশ্বরগঞ্জ, সোনারচর, লঞ্চঘাট এলাকাসহ পূর্ব পাশ ধরে জংলারখাল পর্যন্ত বহু মানুষ এরইমধ্যেই হারিয়েছে তাদের বসতভিটা। অন্যদিকে কাউয়ারটেক থেকে হাজীরহাট পর্যন্ত ভাঙন রয়েছে। এরই মধ্যে পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান মনপুরা ফিসারিজ ভাঙনের কারণে শেষ।

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে স্থানীয় বাসিন্দা মো. আব্বাস বলেন, ‘নদী ভাঙন আমাদের জন্য বড় আতঙ্কের নাম। দিনে দিনে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয় মনপুরা। আমাদের স্বপ্ন ছিল মনপুরা দক্ষিণ বাংলার সুন্দর একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। অথচ সেই স্বপ্ন পূরণ না হতেই ভাঙন শুরু হয়েছে। নদী ভাঙনের সমাধান একটাই  মনপুরার চারপাশে ব্লক চাই।’

এ ব্যাপারে হাজীরহাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. নিজাম উদ্দিন হাওলাদার বলেন, ‘যে পরিমাণে নদী ভাঙছে, তাতে মনে হয় দুই-চার বছরের মধ্যে মনপুরা বিলীন হয়ে যেতে পারে। প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ চলছে। এমপি মহোদয় আমাদের আশ্বস্ত করছেন। তিনিও চেষ্টা করছেন। দীর্ঘ এক বছর করোনার কারণে আসলে কিছুই করা যাচ্ছে না। চেষ্টা করা হচ্ছে, কিভাবে ব্লক দেওয়া যায়।’  

সাকুচিয়া উত্তর ইউপির চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘মনপুরাকে নদীভাঙন থেকে বাঁচাতে একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায়। এই প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পাশাপাশি দ্রুত বাস্তবায়ন হলেই মনপুরাকে রক্ষা করা সম্ভব। তাই সরকারের প্রতি আকুল নিবেদন থাকবে, আমাদের বাঁচানোর জন্য দ্রুত যেন প্রকল্পটি অনুমোদন হয়।’ 

মনপুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিনা আক্তার চৌধুরী বলেন, ‘১৯৭০ সালের বন্যার পরে বঙ্গবন্ধু মনপুরায় এসেছিলেন। ওই সময় তিনি এখানে একটি চিন্তানিবাস করতে চেয়েছিলেন। যে মনপুরাকে বঙ্গবন্ধু এতটা ভালোবাসতেন সে মনপুরাকে এত সহজে বিলীন হতে দেওয়া যাবে না। তাই ছোট ছোট মেরামত বাঁধ নয়, বরং সম্পূর্ণ মনপুরার সীমানায় বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কোভিডের কারণে এ প্রকল্প একনেকে এখনও পাস হয়নি। তবে আমরা আশাবাদী প্রস্তাবিত এই প্রকল্প অনুযায়ী বাঁধ নির্মাণ হলে মনপুরাবাসী রক্ষা পাবে।’

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, ‘বাধ নির্মাণের জন্য এক হাজার ১৯৩ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলেই স্থায়ীভাবে নদীভাঙনের হাত থেকে মনপুরাকে রক্ষা করতে পারব। আমাদের কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে।’