ভেতরে ছেলের লাশ, বাইরে অপেক্ষায় বাবা

Looks like you've blocked notifications!
ছেলের লাশের অপেক্ষায় মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হতভাগ্য বাবা কমল প্রমাণিক।  ছবি : এনটিভি

চারবার টাকা দিয়েও ১৩ বছরের ছেলের লাশ মর্গ থেকে বের করতে পারেনি হতভাগ্য ভ্যানচালক বাবা। ১০ হাজার টাকা দিতে না পারায় সারাদিন লাশ আটকে রাখে মর্গের ডোম। শেষ বিকেলেও ছেলের লাশ না পেয়ে মর্গের সামনেই বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই বাবা। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলতে থাকেন, আমি গরিব মানুষ, টাকা পাবো কোথায়? হৃদয় বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল মঙ্গলবার কুষ্টিয়ার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের মর্গে।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের গাছিরদিয়া টলটলিপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র ভ্যানচালক কমল প্রমাণিক। তাঁর তের বছরের ছেলে শান্ত। কয়েক বছর মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে। অভাবের সংসারে পড়াশুনা ছেড়ে করতো কৃষিকাজ। সোমবার সন্ধ্যায় মায়ের সঙ্গে অভিমান করে নিজ বাড়িতে কীটনাশক পান করে শান্ত।

রাত ৭টার দিকে পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে, রাতেই কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখানে রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি বিভাগ থেকে লাশ মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

গত সোমবার দিবাগত রাত আর মঙ্গলবার দিনভর ছেলের লাশের অপেক্ষায় দিন কাটে কমলের। বিকেল ৪টায় মর্গের সামনে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন কমল।

কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে ওরা আমার ছেলের মরদেহ দেখিয়ে বলে, বুকের অর্ধেক কাটলে পাঁচ হাজার, পুরো কাটলে ১০ হাজার আর কপাল কাটতে আরও ছয় হাজার টাকা দেওয়া লাগবে। তা না হলে লাশ কাটা হবে না। ওদের বারবার বলেছি-আমি গরিব মানুষ, আমার এতো টাকা নেই। ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার চোখের সামনে ছেলের লাশটা গরু ছেলার মতো চর চর করে ফেরে ফেলেছে।’

ভ্যানচালক কমল প্রমাণিকের অভিযোগ, পুলিশের সহযোগিতায় মোটা অংকের টাকা দাবি করেন মর্গের ডোম লক্ষণ ও হীরা লাল।

কমল প্রমাণিক বলেন, ‘পুলিশের সামনে ডোমরা যখন টাকা দাবি করেন, তখন পুলিশ বলছে- এরা কি এসব বোঝে, তুমি এইটুকু কাটবা, এইটুকু কাটবা দেখাচ্ছো। এরা তো ওই সব বোঝে না। যে যেমন লোক, তার সঙ্গে সে রকম করো। আমি পুলিশ ভাইকে বারবার অনুরোধ করে বলছি, ভাই আমি গরিব মানুষ। আমি ভ্যান চালিয়ে খাই। আমার টাকা দেওয়ার মতো কোনো অবস্থা নেই। আমি টাকা কোথায় পাবো? উল্টো পুলিশ আমাকে বলছে, এসব কথা এখানে চলবে না।’

কমল আরও বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি, ভাই আমার টাকা দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই। আমাকে সহযোগিতা করার মতো লোকও নেই। আমার পাশে এসে দাঁড়াবে এমন একটা লোকও আমার নেই। ওরা আমার কোনো কথায় শোনেনি। সকাল থেকে এখন চারটে বাজে, আমার ছেলেকে এখনো নিয়ে যেতে পারেনি। লাশ কেটে এখন বলছে টাকা ছাড়া আমার ছেলেকে দেবে না। আমি এখন টাকা কোথায় পাবো। ১০ হাজার টাকা দিয়ে লাশ নিয়ে যেতে বলছে। আমার কাছে তো টাকা নেই। ভাইগো আমার ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কোনো অবস্থা নেই।’

ভ্যানচালক কমল প্রমাণিক অভিযোগ করে বলেন, ‘রাতে লাশ মর্গে ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে লাশ পাহারা দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা দাবি করে দুইজন ডোম। আমি গরিব মানুষ, আমি টাকা কোথায় পাবো? একথা বলতেই আমার ওপর রেগে উঠে। পরে আমার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করে ওদের দিয়ে রাতে বাড়ি যাই। সকালে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার ৭০০ টাকা, পরে আরও ১০০ টাকা নেয়। দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেও বিভিন্ন খরচের কথা বলে আমার কাছ থেকে এক হাজার ৫৫০ টাকা নিয়ে নেয়।

বিকেলে কয়েকজন সাংবাদিক মর্গের সামনে গেলে লাশকাটা ডোমরা নিজেরাই তাড়াহুড়া করে লাশ একটি অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দেয়।

নিহত শান্তর চাচা মামুন বলেন, ‘সংবাদ শুনে দুপুরে আমি হাসপাতালের মর্গের সামনে এসে দেখি, দুই ডোম ও একজন পুলিশ এক টেবিলে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। পাশে শান্তর বাবা দাঁড়িয়ে টাকা নিয়ে কথা বলছেন। এ সময় আমি মোবাইলে ভিডিও করার চেষ্টা করলে তারা টের পেয়ে যায়। পরে আমাকে ভিডিও করতে দেয়নি।

অভিযোগের বিষয়ে হাসপাতালের মর্গে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল হাবিব জানান, তাঁর সামনেই ডোমরা টাকা দাবি করেছে।

অভিযোগ অস্বীকার করে হাসপাতালের মর্গের ডোম লক্ষণ জানান, তাদের কাছে কোনো টাকা দাবি করা হয়নি। তারা ইচ্ছে করে লাশ ফেলে রেখেছে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুল মোমেন বলেন, ‘এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। অভিযোগ এলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’