দেশীয় মৎস্য উৎপাদনে হুমকি

ভয়ংকর ‘সাকার ফিস’ এখন উন্মুক্ত জলাশয়ে

Looks like you've blocked notifications!
অ্যাকুরিয়ামে চাষযোগ্য বিদেশি ক্ষতিকর সাকার ফিস এখন হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন নদনদী, হাওর ও জলাশয়ে। ছবি : সংগৃহীত

আসল নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিস। তবে সাকার ফিশ নামেই অধিক পরিচিতবৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস। অ্যাকুরিয়ামে চাষযোগ্য বিদেশি প্রজাতির এই ক্ষতিকর সাকার ফিস এখন হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন নদনদী, হাওর ও জলাশয়ে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সাকার ফিস উন্মুক্ত জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ায় দেশীয় অনেক প্রজাতির মাছ খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে। এটি চিংড়ি, কালি বাউস, মাগুর ও শিং মাছসহ ছোট শামুক জাতীয় শক্ত খোলের প্রাণী খেয়ে সাবাড় করে ফেলে।

এ বিষয়ে একজন মৎস্য বিজ্ঞানী বলেন, এই মাছটি ২০০১ বা ২০০২ সালের দিকে ইউরোপের এক কূটনীতিক মেয়াদ শেষে চলে যাওয়া আগে ঢাকার গুলশান লেকে ছেড়ে দেন। এরপর সেখান থেকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এটি। বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রজাতির সাকার ফিশ ১৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। এটি পানি ছাড়াই প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

মৎস্য আইন ২০১১ অনুযায়ী বাংলাদেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ক্ষতি সাধন করে, এমন যেকোনো বিদেশি মাছ আমদানি ও চাষ দণ্ডনীয় অপরাধ।

অ্যাকুরিয়ামের শোভাবর্ধক এই সাকার ফিস উন্মুক্ত পরিবেশ পেয়ে আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। দ্রুত বংশবিস্তার ও প্রচুর খাদ্য গ্রহণের কারণে জলাশয়ের মাছসহ অন্যান্য প্রাণী হুমকির মুখে পড়ছে। এরই মধ্যে এই সাকার ফিসের কারণে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছে বেশ কয়েকটি দেশের মৎস্য খাতদ্রুত বংশ বিস্তারকারী এই সাকার ফিস কীভাবে জলাশয়গুলোতে ছড়াচ্ছে তার সঠিক তথ্য জানে না কেউআর দেশের মৎস্য খাতকে ধ্বংস করতে এটি দেশের প্রত্যন্ত জলাশয়ে ছড়িয়ে দিতে আন্তর্জাতিক কোনো চক্র জড়িত কিনা, এমন প্রশ্ন এখন অনেকেরসাকার ফিস এখন মাছ চাষিদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাকার ফিশের পরিচিতি মূলত শহুরে লোকের কাছে। শহরের বাড়িতে বা অফিসে রাখা অ্যাকুরিয়ামে রংবেরঙের মাছের মধ্যে কালো শরীরের হলুদ ছোপের এই সাকার ফিস দেখা যায় প্রায়ই। অনেকে এটিকে চিনেন অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছের ময়লা খেকো হিসেবে কারণ শোভাবর্ধনের পাশাপাশি মাছের বর্জ্য এবং অ্যাকুরিয়ামের অন্যান্য ময়লা খেয়ে ফেলে এই সাকার ফিসঅনেকেই শুরুর দিকে অ্যাকুরিয়াম ফিস হিসেবে পালন করলেও পরবর্তী সময়ে এটি বড় হয়ে গেলে পুকুর বা ডোবায় ছেড়ে দেয়। সেখানে এটি নতুন পরিবেশে খাপ খেয়ে বংশ বিস্তার শুরু করে। এটি খেতে সুস্বাদু না হওয়ায় সাধারণত কেউ খায় না এবং বাজারেও এর চাহিদা নেই

মিয়ানমার টাইমসে প্রকাশিত সাকার মাউথ ক্যাটফিশ নিয়ে প্রতিবেদন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের শতকরা ২২ ভাগ মাছ উৎপাদন হয় ময়মনসিংহ জেলায়। গত তিন মাসে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন জলাশয়ে অসংখ্যবার এই সাকার ফিসটি পাওয়া গেছে। এটি পাওয়া যাচ্ছে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, যশোর সিলেট খুলনাসহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) জলাশয়গুলোতে। এমনকি ময়মনসিংহে অবস্থিত মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পুকুরেও দেখা গেছে এই সাকার ফিসঅনেকেই নদী বা জলাশয়ে মাছ ধরতে গিয়ে দেখা পাচ্ছে ভয়ংকর এই সাকার ফিসেরতবে আগে সবসময় নদী থেকে দেশি প্রজাতির বিভিন্ন মাছ পাওয়া গেলেও এবার অপরিচিত সাকার ফিস ধরা পড়ছে অনেকের জালে। এটির ব্যাপক বিস্তার ঘটলে দেশীয় প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন মৎস্য গবেষকরা।

তথ্যমতে, সাকার ফিস জলজ পোকামাকড় ও শেওলার পাশাপাশি ছোট মাছ এবং মাছের পোনা খেয়ে থাকে। তা ছাড়া সাকার ফিসের পাখনা খুব ধারালো। মাছের সঙ্গে লড়াই করার সময় ধারালো পাখনার আঘাতে সহজেই অন্য মাছের দেহে ক্ষত তৈরি হয় এবং পরবর্তী সময়ে পচন ধরে সেগুলো মারা যায়। সাকার ফিস রাক্ষুসে প্রজাতির না হলেও প্রচুর পরিমাণে খাবার ভক্ষণ করে। এতে খাদ্যের জোগান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয় অন্য মাছের সঙ্গেবেশিরভাগ সময়ই দেশীয় প্রজাতির মাছ সাকার ফিসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে জলাশয় থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বাকৃবির জলাশয়গুলোতে এখন প্রায়ই ধরা পড়ছে এই সাকার ফিসবিশ্ববিদ্যালয়ের ঈশা খাঁ হল সংলগ্ন লেক ও পাশের জলাশয়ে অনেক বেশি দেখা মিলছে এর। সম্প্রতি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার সঞ্চুর গ্রামে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের পুকুরে প্রায় এক কেজি ওজনের একটি সাকার ফিস ধরা পড়ে।

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, সাকার ফিস একবার কোনো জলাশয়ে ঢুকে পড়লে এর বিস্তার রোধ করা খুব কঠিন। চাষের পুকুরে এই মাছ ঢুকে পড়লে অন্য মাছের সঙ্গে খাবার ও বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। এতে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হলেও মাছের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন পাওয়া যায় না। অন্যদিকে চাষযোগ্য মাছ সাকার ফিসের সঙ্গে খাবার ও বাসস্থানের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। এভাবে মাছ চাষিরা লোকসানের মুখে পড়ে

জিওগ্রাফি অ্যান্ড ইউ ডটকম জানিয়েছে, মিঠাপানির এই সাকার ফিসটির আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশবিশেষত ব্রাজিলে অ্যামাজন অববাহিকায় এটি প্রচুর পাওয়া যায়। এদের মধ্যে লাফানোর প্রবণতা থাকায় এক জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এই মাছের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে মিয়ানমার টাইমস জানিয়েছে, এই মাছ প্রচুর খাদ্য গ্রহণের ফলে জলাশয়ের অন্য মাছ খাদ্য সংকটে পড়ে। এ ছাড়া এই মাছের আঘাতে অন্য মাছের শরীরে ঘা ও ইনফেকশন হয়ে যায়। আক্রান্ত মাছগুলো খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। এতে মাছগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, এক পর্যায়ে সেগুলো মারা যায়। ফলে সাকার ফিসের উপদ্রবে অনেক মৎস্য খামারি পথে বসে। এই অবস্থা মোকাবিলায় চীন থেকে বিশেষজ্ঞ দলও এনেছিল মিয়ানমার, কিন্তু কোনো সমাধান মেলেনি।

বাংলাদেশে এই সাকার ফিস বিস্তার বিষয়ে বিএফআরআইয়ের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) . মো. খলিলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে সাকার মাউথ ক্যাটফিশের বিস্তার নিয়ে এখনও কোনো গবেষণা হয়নি। এটি দ্রুত বংশবিস্তার করায় জলাশয়ের দেশীয় মাছগুলো এখন হুমকির মুখে পড়ছে। এটি ক্যাটফিস জাতের হওয়ায় জলাশয়ের একেবারে নিচের স্তরে থাকে, ফলে এটি খুঁজে খুঁজে সরিয়ে ফেলার কাজটি খুবই কঠিন।

. মো. খলিলুর রহমান বলেন, এটির নিধনে এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে শিগগিরই দেশের মৎস্য খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে