‘মা মুই ভালো আছো, কইল ব্যাটা’

Looks like you've blocked notifications!
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার সময় নিহত নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। ছবি : এনটিভি

শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন মা গুলেনাহার বেগম। তাঁর ছেলে জাহাঙ্গীর আলম মধ্য আফ্রিকায় শান্তিরক্ষী মিশনে গিয়ে বোমা বিষ্ফোরণে নিহত হয়েছেন। শয্যাশায়ী মা গুলেনাহার বলেন, ‘কয়েকদিন আগে অনলাইনে ব্যাটার (ছেলের) সাথে কথা হইল, কইল মা—মুই ভালো আছো (আছি)। মিশন শ্যাষ হয়ছে। কিছুদিন পর দ্যাশোত আসিম (আসব)। তোমরা ভালো থাকো।’ 

কথা বলতে বলতেই ভাষা হারিয়ে ফেলা মা আবারও বললেন, ‘ছেলেটাক ক্যানে মরি গেইল, আল্লাহ মোকে আগোত (আগে) নিয়া গেইলে তো হইল হয়। মুই ছেলেটাক দেখির (দেখতে) চাও (চাই)।’ 

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার জাহাঙ্গীর আলমের বাবা লতিফর রহমানের মুখ থেকে বের হচ্ছে না যেন কোন কথা। বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। থামানো যাচ্ছে না স্ত্রী শিমু আকতারের কান্না। 

আজ বুধবার সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক জাহাঙ্গীর আলমের ডিমলা উপজেলার ডিমলা ইউনিয়নের দক্ষিণ তিতপাড়া গ্রামের বাড়িতে। পরিবারকে সমবেদনা জানাতে স্থানীয় মানুষরা ভীড় করছেন মৃত্যুর সংবাদ জানার পর থেকেই। আজ সকালে সমবেদনা জানাতে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন।

বাবা লতিফর রহমান বলেন, ‘আমার বাবাটা দুর্ঘটনাত মারা গেছে শুনছি, মোর ছাওয়াটাক (ছেলেটার) মুই দেখির চাও। কদদিন মোর ব্যাটাটা আসিবে। তাড়াতাড়ি যেন নিয়া আইসে বাবাক (বাবাকে)। সরকারের কাছে আবেদন, সোনামুখটাক তাড়িতাড়ি যেন দেখির ব্যবস্থা করি দেয়।’

বাবা মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম চতুর্থ। সবার বড় আবুজার রহমানও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য। দিনাজপুরের খোলাহাটি সেনানিবাসে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। প্রথমে দুর্ঘটনার খবরটি সেনাবাহিনী থেকে তাঁকেই জানানো হয়। ছুটি দেওয়া হয় বাড়িতে ফেরার জন্য। 

আবুজার রহমান বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলম পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ সে। বাকি দুই ভাই প্রাইভেট জব করলেও আমরা দুজন সরকারি চাকুরিতে। একেবারে ছোট বাদশা মিয়া রংপুরে পড়ছে পলিটেকনিকে।’

জাহাঙ্গীরকে হারানোর যে দুঃখ বেদনা কীভাবে সইবো আমরা। একজন চলে যাওয়া মানে বিরাট ক্ষতি হওয়া। তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ বিষয়টি দেখভাল করছেন মরদেহ দেশের আনার ব্যাপারে।’ 

চার বছর আগে জলঢাকা উপজেলার মীরগঞ্জ ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের মেয়ে শিমু আকতারের বিয়ে হয় জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। মৃত্যুর বিষয়টি জানার পর থেকে কোনোভাবে থামানো যাচ্ছে না তাঁর কান্না। তার পাশে এসে কান্নায় ঢলে পড়েছেন মা শাহিনুর বেগমসহ আরও তিন বোন।

কান্নাজড়িত অবস্থায় শিমু জানান, পরশু ভিডিও কলে কথা হয় ওর সঙ্গে। জানালো ভালো আছি। কোন সমস্যা নেই। মিশন তো শেষের পথে। কিছুদিন পরই আসছি। ভালো থাকো। 

শিমু বলেন, ‘দ্রুত আমার স্বামীর মৃতদেহ যেন দেশে আনা হয়, সরকার এবং সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে আমার এই আবেদন।’ 

প্রতিবেশি শামসুল হক বলেন, ‘সভ্য, সহজ সরল প্রকৃতি মানুষ ছিল জাহাঙ্গীর। ভালো খেলোয়াড়ও ছিল। তারমতো ছেলে এই এলাকায় নেই। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুক।’

২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন জাহাঙ্গীর। মিশনের যাওয়ার আগে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল সেনানিবাসে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২১ সালের ১২ডিসেম্বর মিশনে যান জাহাঙ্গীর। 

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়েত হোসেন ও ডিমলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লাইছুর রহমান পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে যান জাহাঙ্গীরের বাড়িতে। 

ইউএনও বেলায়েত হোসেন জানান, ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন জাহাঙ্গীর। নিহত হওয়ার ঘটনায় শোক ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। 

মরদেহ দেশে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, ‘দাপ্তরিকভাবে এখোনও আমার কাছে কোন তথ্য আসেনি। তারপরও বিষয়টি খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।’

আইএসপিআর সূত্রে জানা গেছে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার সময় তিন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হন। এরমধ্যে নীলফামারীর জাহাঙ্গীর আলমও রয়েছেন। তিন অক্টোবর সোমবার রাত আটটা ৩৫মিনিটে বাংলাদেশ সময় চার অক্টোবর দুপুর ১টা ৩৫মিনিটে শান্তিরক্ষীদের একটি গাড়ি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিষ্ফোরণে এ ঘটনা ঘটে।