যশোরে ২ দিনব্যাপী জেলা সাহিত্য মেলা কাল শুরু, কর্মকাণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ কমিটি
যশোরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দুই দিনব্যাপী জেলা সাহিত্য মেলা। জেলা প্রশাসনের আয়োজনে আগামীকাল বুধবার শুরু হবে এই মেলা। জেলার আট উপজেলার কবিসাহিত্যিকরা অংশগ্রহণ করবেন এই মেলায়। যদিও অনেকের অভিযোগ, তারা এ বিষয়ে জানেন না কিছুই। অনেকে শুনেছেন অসমর্থিতসূত্রে। জেলা প্রশাসন কিংবা তার কোনো প্রতিনিধি এ বিষয়ে কোনো প্রচার-প্রচারণা করেনি। দেওয়া হয়নি কোনো বিজ্ঞপ্তি। এদিকে, জেলার লেখকদের লেখা নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশের কথা থাকলেও লেখা আহ্বান করা হয়নি। কেউ কেউ বলছেন, একটি কমিটি করে তাদের পছন্দের লোকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এই মেলা। এ নিয়ে জেলায় সমালোচনার ঝড় বইছে। কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। তাদের দাবি—পরিকল্পিতভাবে মেলার আয়োজন হলে সরকারি এই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হতো।
জানা যায়, যশোর টাউনহল মাঠে আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিনব্যাপী এই মেলা অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শিক্ষা ও আইসিটি মোনায়ার হোসেনকে আহ্বায়ক করে করা হয়েছে কমিটি। কমিটিতে আছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক ও কবি হোসেনউদ্দীন হোসেন। অন্যান্যের মধ্যে আছেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ড. সবুজ শামীম আহসান, ড. শাহানাজ পারভীন ও গোলাম মোস্তফা মুন্না।
অভিযোগ বলছে, মেলাতে অংশগ্রহণের জন্য এই জেলার কবি-সাহিত্যিকদের করতে হয়েছে ফরম পূরণ। তবে পূর্বে কোন বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। প্রস্তুতি সভা হয়েছে বলে অনেকে জানেন, তবে অধিকাংশই জানেন না। এ ছাড়া যশোর জেলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি; যশোর জেলার কবিতা ও ছড়া; যশোর জেলার কথাসাহিত্য, নাটক, প্রবন্ধ ও অন্যান্য—এই তিন বিষয়ে পাঠ করা হবে প্রবন্ধ। জেলার কবি-সাহিত্যিকদের লেখা থেকে বাছাই করে এই প্রবন্ধ পাঠের কথা থাকলেও লেখা আহ্বান না করে করা হয়েছে লুকোচুরি। মেলা কমিটির এক সদস্য ড. শাহনাজ পারভীন নিজেই নিজের প্রবন্ধ প্রস্তাব করে তা কমিটির দিয়ে পাস করিয়ে নিয়েছেন পাঠের।
কমিটির এ ধরনের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলার অনেক কবি-সাহিত্যিক। তারা বলছেন, ‘সরকারি চমৎকার একটি উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।’
কবি পলিয়ার ওয়াহিদ বলেন, ‘জেলা সাহিত্য মেলা নিসন্দেহে সরকারের ভালো উদ্যোগের একটি। তবে, বিভিন্ন জেলায় এ পর্যন্ত যে মেলা হয়েছে, সেখানেও তত্ত্বাবধানের অভাব দেখা গেছে। ওই সব জেলার বিপুল কবি-সাহিত্যিক না জানতে পেরে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। যশোরেও তেমনটিই হচ্ছে বলে জেনেছি। এই যেমন আমি এখন আপনার মাধ্যমে জানলাম। তাও মেলার একদিন আগে।’
জেলা পর্যায়ে সাহিত্য মেলায় সরকারে অবদানের প্রসংশা করে কবি ও সাহিত্য সংগঠক খায়রুল কবির চঞ্চল বলেন, ‘এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। জেলার সব কয়টি উপজেলার কবিসাহিত্যিকরা এতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। যদিও যশোরে সাহিত্য মেলার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, বা কোনো মাধ্যমেও জানানো হয়নি। সুন্দর এই উদ্যোগকে ফলপ্রসূ করতে পরিকল্পিত চিন্তা-ভাবনা রাখলে ভালো হতো। আগামীতে যেকোনো আয়োজন আরও সুন্দর ও সুচারুরূপে অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রত্যাশা রাখি।’
এক প্রশ্নে কবি আরশি গাইন বলেন, ‘আমি কয়েকদিন আগে মেলা সম্বন্ধে জেনেছি। তবে, প্রবন্ধ সংগ্রহ বা পাঠ হবে, এমন কিছু জানি না। আর মেলার বিষয়ে কমিটি, কিংবা কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে জানতে পারিনি। লিখিয়ে বন্ধুর মাধ্যমে জেনেছি।’
কবি ও অণুগল্পকার মামুন আজাদ সোমবার বলেন, ‘কয়েকদিন আগে যশোরে বইমেলায় ছিলাম। সেখান থেকে আমার কয়েকজন বন্ধু কবির কাছ থেকে সাহিত্য মেলার বিষয়ে জানতে পারি। সংকলন বের হবে কি না জানি না।’ যদিও গতকাল সাহিত্য মেলা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে আজ বুধবার সকালে তাঁকে মেলা সম্বন্ধে জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
কবি তহীদ মনি বলেন, ‘যশোরের কবি-সাহিত্যিকরা অধিকাংশই জানেন না কারা কীভাবে এ মেলায় যুক্ত হয়েছে বা হচ্ছে। আসলে কোনো বাছাই প্রক্রিয়াই হয়নি। মুখচেনা, ঘনিষ্ঠ আর আজ্ঞাবহদের যুক্ত করে এ মেলার আয়োজন করা হচ্ছে।’
যশোর সাহিত্য মেলা কমিটির সদস্য কবি, ঔপন্যাসিক ও ইতিহাসবিদ হোসেনউদ্দীন হোসেন বলেন, ‘আমাকে আগে না জানিয়ে কমিটিতে নাম রাখা হয়েছে। পরে একদিন মিটিংয়ে ডেকে জানানো হয়—প্রবন্ধপাঠ ও সংকলন বের হবে। সেখানে আগেই তিনজনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। তারাই অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পাঠ করবেন ও সংকলনও তারাই বের করছেন।’
জানা গেছে, সংকলনের জন্য তিনটি প্রবন্ধের একটি লিখেছেন কমিটির সদস্য ড. শাহানাজ পারভীন। যদিও গতকাল মঙ্গলবারের তারিখ উল্লেখ করে কমিটির এই সদস্যের পাশাপাশি আরও একজনের নাম সংযোজন করতে দেখা গেছে।
প্রবন্ধে নিজের নাম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য ড. শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘আমি কমিটির সদস্য। তবে, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলতে পারবেন।’ প্রবন্ধ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, না কি জেলা প্রশাসক নির্ধারণ করেছেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই, জেলা প্রশাসক অথবা কমিটির আহ্বায়ক এটি বলতে পারবেন।’
জানা গেছে, ড. শাহনাজ পারভীন জন্মসূত্রে ফরিদপুর কামারখালীর এবং স্বামীর স্থায়ী বাসস্থানসূত্রে যশোরের।
বাংলা একাডেমির জেলা সাহিত্য মেলার সমন্বয়কারী সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘বাংলা একাডেমি থেকে জেলা সাহিত্য মেলার কর্মকাণ্ড সমন্বয় করা হচ্ছে। বাকি সব সিদ্ধান্ত জেলা প্রশাসন করবে। যদিও যশোর জেলায় মেলা কমিটি নিয়ে নানা কথা আসছে। আমি জেলা প্রশাসক বরাবর যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।’
যশোর জেলা সাহিত্য মেলার কমিটির আহ্বায়ক যশোর জেলা অতিরিক্ত প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোনায়ার হোসেন বলেন, ‘জেলা সাহিত্য মেলা নিয়ে স্থানীয় একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। সেই কমিটি সকল কাজ করছেন। বাকি বিষয়গুলো জেলা প্রশাসক মহোদয় বলতে পারবেন।’
এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এনটিভিকে বলেন, ‘আমরা একটি কমিটি করে দিয়েছিলাম, সেই কমিটি সব নির্ধারণ করেছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জেলা সাহিত্য মেলার বিষয়ে প্রস্তুতি সভা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে যারা কাজ করেন তারা জেলা সাহিত্য মেলার বিষয়ে জানেন।’ কয়েকজনের নাম উল্লেখ ‘জানেন না’ বলে দাবি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাদের চিনি। আমি নিজে তাদের নাম নিশ্চিত করেছি।’