রপ্তানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য চুরি : ২০ কোটি টাকার বাড়ি ও মাছের খামার শাহেদের

Looks like you've blocked notifications!
কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন শেষে আজ শনিবার দুপুরে গ্রেপ্তার আসামিদের হাজির করা হয়। ছবি : এনটিভি

প্রায় শতকোটি টাকা মূল্যের রপ্তানিযোগ্য চোরাই গার্মেন্টস পণ্যসহ সংঘবদ্ধ চোরচক্রের চার সদস্যসহ মূলহোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দাকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। শাহেদচক্র গত দেড় যুগ ধরে রপ্তানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে আসছিল।

কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আজ শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এসব কথা বলেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। 

র‍্যাব জানায়, গাজীপুরের কারখানা থেকে কাভার্ড ভ্যানযোগে পোশাকের একটি চালান ব্রাজিলে রপ্তানির উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠায়। পরের দিন ৮৯৮ কার্টন ভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ক্রেতা-মনোনীত শিপিং প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ২৫ হাজার ডলারেরও বেশি মূল্যের চালানটি গ্রহণ করে ব্রাজিলে পাঠায় এবং সেই মোতাবেক বন্দর থেকে চালানবহনকারী জাহাজটি রওনা দেওয়ার পরপরই ক্রেতা পুরো অর্থ পরিশোধ করে। তবে, গত ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও দেখে হতবাক হয়ে যান গার্মেন্টস মালিকপক্ষ।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সেখানে দেখা যায় যে, কিছু কার্টন সম্পূর্ণ খালি এবং অনেকগুলো কার্টন থেকে প্রচুর পরিমাণ পণ্য খোয়া গেছে। পরবর্তীতে চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয় মালিকপক্ষকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় চুরির ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চোরচক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারসহ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে র‌্যাব। 

এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল শুক্রবার রাতে র‌্যাব-৪ এর পৃথক অভিযানে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে আলোচিত ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত গার্মেন্টস পণ্য চুরিসহ দেশের গার্মেন্টস পণ্য চুরিকাণ্ডের মূলহোতাসহ গ্রেপ্তার করা হয় চারজনকে।  

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মূলহোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা (৫২), মো ইমারত হোসেন সজল (৩৭), শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ (৩০) ও মো হৃদয় (২৮)। এ সময় উদ্ধার করা হয় ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত চুরি যাওয়া পণ্যের পরিবহণে ব্যবহৃত ১টি কাভার্ড ভ্যান। 

গার্মেন্টস পণ্য চুরি চক্রে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা এই গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতের মাস্টারমাইন্ড এবং এই চক্রের মূলহোতা ও নির্দেশদাতা। মূলত তার ছত্রছায়ায় ও সম্মতিতে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। ৪০ থেকে ৫০ জনের এই চক্রে রয়েছে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ট্রান্সপোর্টে গার্মেন্টেসের মালামাল বহন শুরু করে। একপর্যায়ে তারা গার্মেন্টস পণ্য পরিবহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাভার্ডভ্যানের ড্রাইভার ও হেলপারদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে এবং অল্প সময়ে বেশি অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরির কাজে উৎসাহিত করে। প্রত্যেকটি চুরির ঘটনা সংঘটনের আগে ড্রাইভারদের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানিকৃত গার্মেন্টস পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে চোরাইকৃত পণ্যের সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করত।  

রপ্তানিকৃত পণ্য চুরির নির্দেশ দেওয়া হয় যেভাবে

ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত পণ্য চুরির ঘটনাও শাহেদের নির্দেশে সংঘটিত হয়। গত বছরের ২৯ অক্টোবর গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস পণ্য কাভার্ড ভ্যানে লোড করে সন্ধ্যার সময় চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে। কাভার্ড ভ্যানে পণ্য লোডের পর গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ড্রাইভার শাহজাহানের কাছে স্যাম্পল হিসেবে কিছু সোয়েটার প্রদান করে। ড্রাইভার শাহজাহান স্যাম্পল পাওয়ার পরপরই ছবি তুলে মোবাইলের মাধ্যমে মূলহোতা শাহেদের কাছে পাঠায়। শাহেদ স্যাম্পল পেয়ে এই চুরির ঘটনা বাস্তবায়নকারী আসামি তাওহীদুল ওরফে কাওছার ওরফে বড় কাওছারের কাছে পাঠায় এবং পণ্যের গুনগত মান ও বাজারমূল্য বিবেচনা করে এই চালানটিতে চুরির নির্দেশ দেয়।  

পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিংয়ের পর বন্দরের পাঠিয়ে দেয় তারা

খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, মাস্টারমাইন্ডের নির্দেশ মোতাবেক কাওছার ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুরির মূল প্লট বাস্তবায়ন করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাওছারের নির্দেশে ড্রাইভার ও হেলপার ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে ডেমরা থানাধীন মিরপাড়াস্থ আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে কাভার্ড ভ্যানটি পার্ক করিয়ে এই চুরির ঘটনা ঘটায়। আগে থেকে আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে অপেক্ষারত কুলি সর্দার নাজিম, স্থানীয়ভাবে শেল্টারদাতা মাসুম ওরফে মাসুদসহ অজ্ঞাতনামা ৫ থেকে ৭ জন লেবার নিয়ে মূলহোতা কাওছার প্রত্যেকটি কার্টন থেকে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং করে কাভার্ড ভ্যানটি বন্দরের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়। 

এ ঘটনায় কার্টন প্যাকেজিংয়ে অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দার নাজিম অন্যান্য লেবারদের নিয়ে কাভার্ড ভ্যান থেকে কার্টন আনলোড থেকে শুরু করে কার্টন থেকে পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং এবং কাভার্ড ভ্যানে কার্টন লোডের কাজটি করেছে।  

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাওছার, নাজিম ও মাসুম ওরফে মাসুদকে রাজধানীর ডেমরা থেকে গত ২৪ ডিসেম্বর র‌্যাব-৪ অপর একটি গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনায় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে এবং বর্তমানে আসামিরা জেল হাজতে রয়েছে। 

খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গ্রেপ্তার শাহেদ চট্টগ্রামে থাকাকালে ১৯৯৬ সালে দুটি ট্রাক কিনে লোকাল ব্যবসা শুরু করে এবং ২০০৪ সালে ট্রাক দুটি বিক্রি করে ৪টি কাভার্ড ভ্যান কিনে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহণ শুরু করে। তিনি কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার এবং হেলপারদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সহায়তায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির কার্যক্রমের জন্য একটি সংঘবদ্ধ চোর চক্র তৈরি করে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি নিজেই স্বশরীরে উপস্থিত থেকে চুরির কার্যক্রম চালিয়ে যান। 

চুরির টাকায় শাহেদের ২০ কোটি টাকার বাড়ি, মাছের খামার 

শাহেদ ২০১৮ সাল পরবর্তী সময়ে সে পর্দার আড়ালে থেকে চুরির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ শুরু করে এবং প্রত্যেকটি চুরির ঘটনায় আয়কৃত অর্থের সর্বোচ্চ অংশ তিনি পেতেন। শাহেদ গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে এই গার্মেন্টস পণ্য চুরির জগতে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছেন। মৌলভীবাজার শহরে সাহেদের প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি রয়েছে। মৌলভীবাজারের দুর্লভপুর প্রায় ২০ একর জমির ওপরে মাছের খামারসহ বিশাল দুটি হাঁস মুরগির খামারও রয়েছে এবং বর্তমানে তার নিজস্ব ৪টি কাভার্ড ভ্যানসহ তার সহযোগীর আরও ১৫টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে এবং যার অধিকাংশ মামলায় তিনি কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আদালতে ৬টি মামলার বিচারাধীন।