শিক্ষক হত্যা : ‘হিরোইজম’ প্রদর্শনের জন্য হামলার পরিকল্পনা শিক্ষার্থীর

Looks like you've blocked notifications!
নিহত শিক্ষক উৎপল কুমার। ছবি : সংগৃহীত

সাভারের আশুলিয়ার কলেজ শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। র‍্যাব বলছে, উৎপল কুমার সরকারকে স্টাম্প দিয়ে আঘাত করার জন্য অনেকক্ষণ থেকে সুযোগ খুঁজছিল অভিযুক্ত শিক্ষার্থী। সেজন্য আশুলিয়ার হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মধ্যে স্টাম্প নিয়ে রেখেছিল সে। ওই সময় কখন উৎপল কুমার একাকী থাকবেন, সেজন্য খেয়াল রাখছিল ওই শিক্ষার্থী।

র‍্যাবের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ক্ষুব্ধ হয়ে এবং বান্ধবীর কাছে ‘হিরোইজম’ প্রদর্শন করার জন্য এ হামলার পরিকল্পনা করেছিল ওই শিক্ষার্থী।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ২৫ জুন ঢাকার আশুলিয়ার হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রীদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছিল। সে সময়ে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে আঘাত করে গুরুতরভাবে আহত করে ওই প্রতিষ্ঠানেরই এক শিক্ষার্থী। পরে আহত শিক্ষককে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার ভোরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

র‍্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘স্টাম্প দিয়ে আঘাত করে শিক্ষককে হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি ওই শিক্ষার্থীকে গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘নিহত শিক্ষক উৎপল কুমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ২০১৩ সালে আশুলিয়ার হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ওই কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের স্কুল ইউনিফর্ম, চুলকাটা, ধুমপান করা ও উত্যক্তসহ বিভিন্ন নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গজনিত বিষয়ে প্রেষণা প্রদান করতেন তিনি। এ ছাড়া, তিনি ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খেলাধুলা পরিচালনা করাসহ শিক্ষার্থীদের সুপরামর্শ দেওয়া এবং উদ্বুদ্ধ করা ও কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে সৃজনশীলতা বিকাশে ভূমিকা রাখতেন।’

খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়া ওই শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানটির দশম শ্রেণিতে পড়ে। সে শিক্ষাজীবনে বিরতি দিয়ে প্রথমে স্কুল, এরপর মাদ্রাসা ও পরে আবারও স্কুলে ভর্তি হয়। সে ওই স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে বর্তমানে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। সে স্কুলে সবার কাছে একজন উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সময় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, মারামারিসহ স্কুলের পরিবেশ নষ্টের জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। সে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে এবং স্কুল চলাকালে ছাত্রীদের উত্যক্ত ও বিরক্ত করতো, স্কুল প্রাঙ্গণে সবার সামনে ধুমপান করতো, ইউনিফর্ম ছাড়া স্কুলে আসা-যাওয়া করতো এবং মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করতো। তার নেতৃত্বে এলাকায় একটি কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার অভিযোগও রয়েছে। পাশাপাশি গ্যাং সদস্যদের নিয়ে মাইক্রোবাসে করে যত্রতত্র আধিপত্য বিস্তার করতো সে। পরিবারের কাছে তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে সে তার অনুসারী গ্যাং সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে তাদের ওপর চড়াও হতো এবং বিভিন্ন সময় এলাকায় ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে হামলা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে শোডাউন দিতো বলে জানা যায়।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, ওই শিক্ষার্থী জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, ঘটনার কয়েকদিন আগে ওই স্কুলের এক ছাত্রীর সঙ্গে তার অযাচিতভাবে ঘোরাফেরা থেকে বিরত থাকার বিষয়ে শিক্ষক উৎপল কুমার প্রেষণা প্রদান করেন। এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে এবং ওই ছাত্রীর কাছে নিজের ‘হিরোইজম’ প্রদর্শন করার জন্য শিক্ষকের ওপর হামলার পরিকল্পনা করে।

খন্দকার আল মঈনের দাবি, পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই শিক্ষার্থী গত ২৫ জুন একটি ক্রিকেট খেলার স্টাম্প স্কুলে নিয়ে যায় এবং তা শ্রেণিকক্ষের পেছনে লুকিয়ে রাখে। সে তার শিক্ষককে আঘাত করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। পরে কলেজ মাঠে ছাত্রীদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালে শিক্ষক উৎপল কুমারকে মাঠের এক কোনে একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে তার কাছে থাকা ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে অতর্কিতভাবে বেধড়ক আঘাত করতে থাকে। ওই শিক্ষার্থী প্রথমে পেছন থেকে মাথায় আঘাত করে এবং পরে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে গুরুতরভাবে জখম করে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ঘটনার দিন ওই শিক্ষার্থী এলাকায় সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করলেও পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় এলাকা ত্যাগ করে। প্রথমে বাসযোগে মানিকগঞ্জে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাত্রীযাপন করে। পরদিন আবার অবস্থান পরিবর্তন করে আরিচা ফেরিঘাটে পৌঁছায়। সেখান থেকে ট্রলারযোগে পাবনার আতাইকুলাতে তার এক পরিচিতের বাড়িতে আত্মগোপণ করে। পরদিন ভোরে আবারও তার অবস্থান পরিবর্তন করার জন্য আতাইকুলা থেকে বাসযোগে কাজিরহাট লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে লঞ্চযোগে আরিচাঘাট পৌঁছায়। সেখান থেকে বাসযোগে গাজীপুরের শ্রীপুরের ধনুয়া গ্রামে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় র‍্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে।