বিশ্ব আদিবাসী দিবস

সমস্যা ও সম্ভাবনায় সাতক্ষীরার আদিবাসী মুন্ডাদের জীবন

Looks like you've blocked notifications!
আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়। ছবি : এনটিভি

‘ধান রুপিলা, জোন খাটিলা, মানুষ করিলা ছোয়াল পোতা…
হা ভগবান, জাগা-জমি, সব মোর ভিটে হায় লে নিলা’

আদিবাসী মুন্ডা নারীরা দলবেঁধে এভাবেই গান গেয়ে গেয়ে মাঠেঘাটে কাজ করে। তাঁরা শামুক খোটে, মাটি কাটে, মহাজনের জমিতে কাজ করে। ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত তাঁরা। সামাজিক এমন নানা বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার এসব আদিবাসীরা এখন সমাজের মূলধারার উঠে আসার চেষ্টা করেছে। তাঁরা ভোট দিচ্ছে, লেখাপড়া শিখছে, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিও করছেন। তবু সামাজিকভাবে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে তাঁরা। 

আদিবাসী মুন্ডা নারীদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার আগ্রহ কম। জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে মোটেও সচেতন ছিলেন না তাঁরা। সেই এখনও অনেকেই প্রাচীন ধ্যান-ধারণা পোষণ করলেও সাম্প্রতিককালে মুন্ডা নারী-পুরুষরা জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে অনেকটাই সচেতন হয়ে উঠছে। 

জানা যায়, দুইশ বছর আগে ভারতের রাঁচিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আদিবাসী মুন্ডারা সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করে। তখন থেকেই সুন্দরবনকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে মুন্ডাদের জীবন জীবিকা। এসব জমি তাঁরা আদিকাল থেকে নিজেদের হিসেবে ভোগ দখল করলেও এখন পর্যন্ত এই জমিতে তাদের দালিলিক স্বত্ব নেই। ফলে তাঁরা এসব জমি কারও কাছে বিক্রি করতে পারে না। কেউ কিনতেও পারে না। 

এক সময় মুন্ডারা সুন্দরবনের হরিণ, শুকর, সাপ, বনমোরগসহ বিভিন্ন প্রাণী শিকার করতেন। সেসব প্রাণী নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতেন। তবে বন্যপ্রাণি নিধন আইন প্রচলিত হওয়ার পর, সাতক্ষীরা অঞ্চলের মুন্ডারা সেসব পেশা থেকে সরে এসেছেন। বর্তমানে তাঁরা সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরে, কাঁকড়া ধরে, এমনকি বনবিভাগের পাস-পারমিট (অনুমতি) পেলে মধু আহরণ ও  জোংড়া খোটার কাজও করেন। মুন্ডা পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই সমান তালে কাজ করেন। ঘেরে মাছ ধরা, মাছ চাষ করাসহ কৃষিভিত্তিক নানা কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। তবে মাঠেঘাটে তাদের কাজের দাম কম। তারা একদিন কাজ না করলে পরদিন সংসার চালাতে পারে না।

সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় সাড়ে পাঁচশ মুন্ডা পরিবার রয়েছে বলে জানা যায়। তাদের সদস্য সংখ্যা চার হাজারের কম নয়। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিপুর, সাপখালি, কচিখালি, তারানিপুর, ধুমঘাট, কালিঞ্চি, মুন্সিগঞ্জ, রমজান নগর, তালা উপজেলার বাগডাঙ্গা আড়ুয়াখালিসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের বসতি রয়েছে। এছাড়াও খুলনার কয়রা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তাদের বসতি রয়েছে। এসব বসতিতে তাঁরা নিজেদের মতো করে বাড়িঘর তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে।

সাতক্ষীরার মুন্ডা পরিবারগুলোতে লেখাপড়ার সুযোগ কমই ছিল। জেলার শ্যামনগর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের কৃষ্ণপদ মুন্ডাই ছিলেন প্রথম যুবক, যিনি উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পাস করেন। পরে সাতক্ষীরার বংশীপুরের গির্জার ফাদার লুই পাজ্জির সহায়তায় কৃষ্ণপদ মুন্ডা তাঁর গ্রামে গড়ে তোলেন একটি প্রাথমিক শিক্ষালয়। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের একাই পড়াতেন তিনি। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার জন্য বইখাতা, কাগজ, কলম সরবরাহ করতেন ফাদার লুই পাজ্জি। শিক্ষক কৃষ্ণপদ মুন্ডার মাসিক বেতনও দিতেন লুই পাজ্জি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে মুন্ডা বসতি এলাকায় কমিউনিটি স্কুল তৈরি হয়েছে। সেখানে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে। নিকটস্থ প্রাথমিক বিদ্যালয়েও শিশুরা লেখাপড়া করে। সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া উপবৃত্তি পায় মুন্ডা শিশুরা। এমনকি বিনামূল্যে লেখাপড়া, স্কুলের খাদ্য সহায়তা, বই-খাতা থেকেও বঞ্চিত নয় বর্তমানের শিক্ষার্থীরা।

কৃষ্ণপদ মুন্ডা ও লুই পাজ্জি প্রথম শিক্ষার আলো ছড়িয়েছিলেন মুন্ডা পাড়ায়। এছাড়াও লুই পাজ্জি শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কচিখালিতে, তালার বাগডাঙ্গা, আড়ুয়াডাঙ্গা, মুন্নাসহ বিভিন্ন এলাকার মুন্ডা বসতিতে নতুন নতুন ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। সাতক্ষীরার অধিকাংশ মুন্ডাদের বসবাস ছোট ছোট ভাঙাচোরা ঘরে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের এসব বসতঘরের খানিকটা উন্নতিও হয়েছে। এছাড়া মুন্ডা সদস্যদের অনেকেই পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নতুন ঘর। মুন্ডা জনগোষ্ঠী সেখানে অনেকটাই আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। তবে অধিকাংশ মুন্ডাদের ঘরবাড়ি এখনও মাটির। গরান কাঠের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনির ঘরে তাদের বসবাস।

শ্যামনগরের মুন্ডা বসতিতে রয়েছে খাবার পানির সংকট। লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় সেখানে টিউবওয়েল বসানো হয় না। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা একাধিক মুন্ডাপাড়ায় পানির ড্রাম বসিয়ে দিয়েছে। এসব পাত্রে মুন্ডারা বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা সারাবছর পান করে। খাবার পানির সংকট দেখা দিলে পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে পানি সংগ্রহ করে মুন্ডা নারীরা। পুকুরের পানি অথবা পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) থেকেও খাবার পানি সংগ্রহ করে তারা।

মুন্ডাদের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় আচার। মুন্ডারা শারুল পূজা, কারামপূজা এবং মনসাপূজা করে থাকেন নিজেদের মন্দিরে। এরা বিভিন্ন পূজাসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে হাড়িয়া মদ ব্যবহার করে থাকে বলে জানা যায়। মুন্ডাদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে শামুক, ইঁদুর, জোংড়া, ঝিনুক, কাঁকড়া, কুচে, কচ্ছপ ইত্যাদি। তবে রুচিভেদে এসব খাবার খান মুন্ডারা। মুন্ডাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। তাঁরা সাদৃ ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলে। এ এলাকায় মুন্ডা ছাড়াও মাহাতো এবং উরাও সম্প্রদায়ের সদস্যরা রয়েছেন।

মুন্ডারা এখনও মহাজনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁরা মহাজনদের থেকে ঋণ নেয়। বছর শেষে নির্দিষ্ট সময়ে সেই ঋণ তাদের পরিশোধ করতে হয়। মহাজনদের ঋণ পরিশোধ করা মুন্ডারা পুণ্যের কাজ মনে করে। তবে এই সুযোগে মহাজনরা তাদের থেকে অর্ধেক দামে মাছ, কাঁকড়া কিংবা শস্যদানা কিনে নেন। একরকম শ্রমদাস হিসেবে মহাজনদের নিয়ন্ত্রণে থাকে মুন্ডারা।

মুন্ডা তরুণ তরুণীরা শ্যামনগর উপজেলা সদরে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা কর্মক্ষেত্র বেছে নিচ্ছি। তবুও সামাজিকভাবে তাঁরা নানা বৈষম্যের শিকার। তারা বিয়েবাড়িতে কিংবা অন্যকোনো অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পায় না। যদিও বা পান তাদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি হোটেল-রেস্তোরাঁয় তাঁরা খেতে বসলে নানা বৈষম্যের শিকার হন। কোনো কোনো সময় তাঁরা অন্যদের পুকুরের পানি ব্যবহারের সুযোগ পান না।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরে আদিবাসী মুন্ডাদের একটি সংগঠন রয়েছে ‘সামস’। এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা মুন্ডা পরিবারগুলোকে দেখভাল করে। মুন্ডাদের সামাজিক অধিকার আদায়ে সংগঠনটি আন্দোলন করে থাকে। সংগঠনটির সভাপতি কালিঞ্চী গ্রামের গোপাল মুন্ডা জানান, ‘এখন আগের অবস্থা নেই। আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে, প্রশিক্ষণ পাচ্ছে, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিও পাচ্ছে।’

গোপাল মুন্ডা বলেন, ‘সামাজিক বৈষম্যও অনেকটা দূর হয়েছে। তবুও মূল ধারার জনগোষ্ঠীদের সঙ্গে আমরা এখনও পুরোমাত্রায় নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারিনি।’

সামসের সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণপদ মুন্ডা জানান, মুন্ডাদের মরদেহ বেশিরভাগ সমাধিস্থ করা হয়। তবে জায়গার সংকটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে তাদের শ্মশানে দাহ করা হয়ে থাকে।

মুন্ডা প্রতিনিধি রতিকান্ত মুন্ডা বলেন, ‘মুন্ডা নারীরা সেলাইসহ বিভিন্ন হাতের কাজ করেছে। এতে তাঁরা অর্থ উপার্জন করে থাকে। শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রামে মুন্ডারা গড়ে তুলেছে ম্যানগ্রোভ ভিলেজ। সেখানে একটি মিনি পর্যটন কেন্দ্রও গড়ে তুলেছে তাঁরা। পরিবেশবান্ধব এই পর্যটন ভিলেজের উন্নয়নে সরকারি কোনো সহযোগিতা পায়নি মুন্ডারা।’

রতিকান্ত মুন্ডা জানান, শ্যামনগরের আটটি ইউনিয়নেই রয়েছে আদিবাসীদের বসবাস। ফাদার লুই পাজ্জি তাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা দিচ্ছেন। জমির দালিল না থাকার সুযোগে প্রভাবশালীরা মুন্ডাদের জমি দখল করে নিয়েছে। এ নিয়ে শ্যামনগরে বেশ কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে।

মুন্ডারা আশাবাদ জানায়, ৯ আগস্টের বিশ্ব আদিবাসী দিবসে আবারও উচ্চারিত হবে তাদের ভূমি অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার ও সামাজিক সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা।

আদিবাসীরা তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন করে যাচ্ছে। তাঁরা ভূমির অধিকার দাবি করেছে। এসব জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসতে হলে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানান আদিবাসী মুন্ডারা।