১৮ বছরের শিকলবন্দি জীবনের অবসান হলো ওসমানের
ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর ধরে শিকলবন্দি অবস্থায় আলোবাতাসহীন জরাজীর্ণ পরিত্যক্ত ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন মানসিক ভারসাম্যহীন ওসমান মোল্যা ওরফে রবিউল (২৯) নামের এক যুবক।
ওসমান বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের পশ্চিম চরবর্ণী গ্রামের ভ্যানচালক মো. নুরুল ইসলামের ছেলে। বিষয়টি ফেসবুকে ছবিসহ পোস্ট হলে দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় সারাদেশে।
এদিকে, আজ মঙ্গলবার সকালে পুলিশ প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের তরফ থেকে পাবনায় মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, কোরবানির ঈদের দিন বোয়ালমারী উপজেলার ছোলনা গ্রামের বাসিন্দা সুমন রাফি কোরবানির মাংস, চাল, ডাল, তেলসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী নিয়ে দেখতে আসেন ওসমানকে। এ সময় তিনি নগদ কিছু টাকাও দেন ওসমানের পরিস্থিতি দেখে। এরপর সুমন রাফি তাঁর ফেসবুকে পোস্ট দেন ছবিসহ। এই পোস্টটি দেখার পর উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন তাকে দেখতে তার বাড়িতে যান। ওসমানকে দেখার পর তাদের চোখ কপালে ওঠে। তারা জানতে পারেন দীর্ঘ ১৮ বছর ওসমান এই একটি ঘরে শিকলবন্দী অবস্থা দিনপাত করছেন। মাটির ঘরটি তিনি একটি কুয়ার মতো করে হাত দিয়ে কেটে সেই গর্তে তার জীবনযাপন করছেন। গর্তটি হবে প্রায় ২০ ফুটের মতো।
এ বিষয়ে ওসমানের বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ওসমান আমার বড় ছেলে। ওর বর্তমান বয়স ২৯ বছর। ওর বয়স যখন আট থেকে ১০ বছর তখন ওর জ্বর হয়। তারপর থেকে আস্তে আস্তে শরীর শুকিয়ে যায়। স্থানীয় ছাড়াও জেলা সদর থেকে শুরু করে বড় বড় ডাক্তার, কবিরাজ, ফকির, হুজুরের সব ধরনের চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। দিন দিন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ভাঙচুর-পাগলামি করার কারণে কোমরে ও পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি।’
ওসমানের বাবা আরও বলেন, ‘একদিন আমার সব ছিল। কৃষিজমি, দুইটা মুদি দোকান, এখন তা আর নেই, সব শেষ। ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমি এখন পথের ফকির। ওসমানসহ আমার তিনটি ছেলে। মেজ ছেলে ইমরান কৃষিকাজ করে, ছোট ছেলে কোরআনে হাফেজ। আমি এখন ভ্যান চালিয়ে কোনোমতে সংসার চালাই।’ এদিকে, অভাবের সংসারে কেউ খোঁজ নেন না বলেও জানান তিনি।
প্রতিবেশী আক্কাস বলেন, ‘আমরা ওসমানকে এই অবস্থা দেখে আসছি ১৮ বছর। বর্তমানে যে ঘরে থাকে সেখানে দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগেরও বেশি এই ঘরেই পড়ে আছে। মাজায় ও পায়ে শেকল দিয়ে বাঁধা। সারাদিন শুধু হাত দিয়ে মাটি খোঁড়ে। হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না। শরীরে কোনো কাপড়-চোপড় রাখে না।’
বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, ‘আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসার পর জানতে পারি। বিষয়টি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্যার ও পুলিশ সুপার মো. আলীমুজ্জামান জানতে পেরে দ্রুত আমাদের থানাকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। আমরা সরেজমিনে পরিদর্শন করি। তাকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক ছাড়াও যা যা সুবিধা দেওয়ার সব দেওয়া হবে। আজ সকালে একটি মাইক্রোবাস ও ১৫ হাজার টাকা দিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে ওসমানকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে।’
বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ্র বলেন, ‘আমরা ওসমানের বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে তাকে দ্রুত সুস্থ করে তোলার ব্যাপারে কাজ করছি। এছাড়া তার পরিবারকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও খাদ্যসামগ্রী ও জামা কাপড় দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। এখন আজ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ওসমান যাতে সুস্থভাবে পরিবারে ফিরে আসতে পারে সেই কাজটির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন।’