২০ বছর ছদ্মবেশে থাকা ফাঁসির আসামি গ্রেপ্তার
বিভিন্ন এলাকায় কখনও উদ্বাস্তু, কখনও বাবুর্চি, কখনও দারোয়ান কিংবা কখনও দুর্বৃত্তদের ছত্রছায়ায় ২০ বছর ধরে ছদ্মবেশে আত্মগোপনে ছিলেন হত্যা মামলার আসামি সৈয়দ আহমেদ। বানিয়েছিলেন ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র। এমনকি পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিলেন। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের কারণে তাঁকে আসামি হিসেবেও শনাক্ত করা যাচ্ছিল না।
অবশেষে প্রায় ২০ বছর পর সৈয়দ আহমেদকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় র্যাব। চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ এলাকা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে লোহাগাড়ার আলোচিত ব্যবসায়ী জানে আলম হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক এ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও কার্যালয়ে আজ শুক্রবার সকালে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, ‘২০০১ সালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় মাহমুদুল হক নামের এক ব্যক্তিকে হত্যা করেন সৈয়দ আহমেদ এবং তাঁর তিন ভাই। এ ঘটনায় মামলা পরিচালনার কারণে পরের বছর মাহমুদুলের ভাই জানে আলমকে হত্যা করেন সৈয়দ আহমেদ এবং তাঁর সহযোগীরা। এ ঘটনায় ২০০২ সালে সৈয়দ আহমেদসহ ১২ জনকে ফাঁসির রায় দেন আদালত। পরে উচ্চ আদালত দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে বাকি ১০ আসামির ফাঁসির রায় বহাল রাখেন।
র্যাবের কর্মকর্তারা জানান, খুনের ঘটনার পর সৈয়দ আহমেদ প্রথমে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাগর উপকূলে জলদস্যুদের মাঝি হিসেবে কাজ করেন। পরে চট্টগ্রাম নগরীর সলিমপুরে এক সন্ত্রাসীর ছত্রছায়ায় থেকে ভিন্ন নামে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র করান। কিন্তু, সলিমপুরে ২০১৬-১৭ সালে পুলিশের অভিযান বাড়লে সেখান থেকে সরে গিয়ে কিছুদিন মাজারে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করার পর আকবর শাহ এলাকায় দারোয়ানের চাকরি নেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর র্যাব তাঁর সন্ধান পায়। তাঁকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। জানে আলম হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে দুজন কারাগারে রয়েছেন, তিন জন মারা গেছেন এবং বাকিরা এখনও পলাতক বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাবের বক্তব্য
২০০২ সালের ৩০ মার্চ আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার প্রাক্কালে সকাল ৯টার দিকে ব্যবসায়ী জানে আলমকে (৪৮) তাঁর এক বছর বয়সী সন্তানের সামনে প্রথমে লাঠিসোটা, দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে সৈয়দ বাহিনীসহ স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতকারী। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাঁকে গুলি করা হয়। ওই সময় এ ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর বড় ছেলে মো. তজবিরুল আলম বাদী হয়ে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানায় ২১ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। এর মধ্যে সৈয়দ আহমেদ ২ নম্বর এবং অন্যতম প্রধান আসামি ছিলেন।
এর মাত্র চার মাস আগে ২০০১ সালের ৯ নভেম্বর জানে আলমের ছোট ভাইকে ওই বাহিনী একইভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায়ও লোহাগাড়া থানায় ১৩ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ওই মামলাতেও সৈয়দ আহমেদ ২ নম্বর এবং অন্যতম প্রধান আসামি ছিলেন।
এর মধ্যে ব্যবসায়ী জানে আলম হত্যা মামলায় আদালত ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১২ জনকে ফাঁসি এবং আট জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পরে আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করলে সৈয়দ আহমেদসহ মোট ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে বাকি দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ এবং অন্যদের খালাস দেন।
জিজ্ঞাসাবাদে এ হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ হিসেবে জানা যায়—ব্যবসায়ী জানে আলম ২০০১ সালের ৯ নভেম্বর তাঁর ছোট ভাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। মূলত জানে আলম পরিবারের বড় ছেলে এবং আর্থিকভাবেও কিছুটা স্বচ্ছল ছিলেন। তাই, মামলা-মোকদ্দমার ব্যয়ভার তিনি বহন করতেন। এতে তাঁর ওপর প্রতিপক্ষের আক্রোশ দিন দিন বেড়ে যায়।
প্রতিপক্ষের ধারণা ছিল যে, ব্যবসায়ী জানে আলমকে হত্যা করলে ওই পরিবারের মামলা-মোকদ্দমা চালানোর মতো লোক থাকবে না এবং প্রত্যক্ষভাবে আর কোনো সাক্ষীও থাকবে না। আর্থিকভাবে তাঁদের পরিবার দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তাঁর সব সম্পত্তি সহজে তাঁরা গ্রাস করতে পারবে। এ কারণে ঘাতক চক্র প্রকাশ্য দিবালোকে ব্যবসায়ী জানে আলমকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
প্রথম হত্যা সংঘটিত হওয়ার পরপরই সৈয়দ আহমেদ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বিভিন্ন ডাকাতদলের সঙ্গে সমুদ্র পাড়ি দেন। সেখান থেকে চার মাস পর ফিরে ব্যবসায়ী জানে আলমকে হত্যার পর আবার বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করতে থাকেন। তিনি প্রথম চার থেকে পাঁচ বছর পরিবার-স্বজনদের ছেড়ে বাঁশখালী, আনোয়ারা, কতুবদিয়া ও পেকুয়ায়ার সাগর উপকূলবর্তী এলাকায় থাকতে শুরু করেন। পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় উদ্বাস্তু হিসেবে বিভিন্ন জায়গার ভুয়া ঠিকানা দিয়ে অবস্থান করেন।
এ ছাড়া সৈয়দ আহমেদ জঙ্গল সলিমপুরে মশিউরের ছত্রছায়ায় ও সহযোগিতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু, পুলিশ ও র্যাবের অভিযানের জন্য সেখানে নিরাপদ মনে না করায় তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন মাজার এলাকায় বাবুর্চির কাজ করতে থাকেন। এরপর চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবর শাহ থানায় একটি বাড়িতে দারোয়ানের ছদ্মবেশে কাজ নেন তিনি। সেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
পলাতক থাকাকালে আসামি সৈয়দ আহমেদ ভুয়া ঠিকানায় দুটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে ফেলেন এবং নিজের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখেন। এজন্য তাঁকে কোনোভাবেই হত্যা মামলার আসামি বলে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না।