২৬ মিনিটের শুনানি, কাঠগড়া থেকে কারাগারে সাংবাদিক শামস

Looks like you've blocked notifications!
ঢাকার সিএমএম আদালতে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস। ছবি : প্রথম আলো

রাজধানীর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। আজ বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সকাল ১০টায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নেওয়া হয়। এরপর দুপুর ২টা ২৪ মিনিটে ঢাকার এডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে হাজির করা হয় শামসকে। 

আদালতে  পিনপতন নীরবতায় জামিন শুনানি শুরু হয়ে শেষ হয় বেলা ২টা ৫৪ মিনিটে। ২৬ মিনিটের শুনানিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের চারতলার আদালত কক্ষে বিচারকের বামপাশে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ছিলেন সাংবাদিক শামস। এ সময় আদালতের সামনে আইনজীবী ও সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। পেছনে ছিল পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা বলয়।

শুনানির শুরুতে সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত, আজকে উপস্থিত আসামি দৈনিক প্রথম আলোর স্টাফ রিপোর্টার। তিনি গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে একটি নিউজ করেছিলেন, যা পত্রিকাটির অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত হয়। নিউজের সঙ্গে প্রকাশিত ছবিটি ভুল হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর দ্রুত শুধরে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে দুঃখ প্রকাশ করে সংবাদও পরিবেশন করা হয়। কিন্তু, আজকে  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। এ মামলার এজাহারে বর্ণিত ঘটনা, অর্থাৎ প্রতিবেদনটি করা হয়েছে দিনমজুর জাকির হোসেন এবং সবুজ নামের প্রথম শ্রেণির একজন ছাত্রের বক্তব্য দিয়ে। এটিতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। এখানে দেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়নি। কোনো স্বাধীনতা বিরোধীর মিথ্যা তথ্য দিয়ে উদ্দেশমূলকভাবে রিপোর্ট করা হয়নি।’ এরপর তিনি আদালতকে বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত আমার সিনিয়র আরও শুনানি করবেন।’

পাশে দাঁড়ানো সিনিয়র আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী শুনানিতে বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত; আজকের মামলার এজাহারটি আমার দেখার সুযোগ হয়নি। আপনি যদি আমাকে একটু পড়ার সুযোগ দিতেন।’ 

এ সময় বিচারক তাঁর সামনে থাকা মামলার এজাহারটি আইনজীবীর দিকে বাড়িয়ে দেন। পরে আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী রমনা থানায় দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটির এজাহার পড়তে থাকেন। তখন আদালত বলেন, ‘আওয়াজ করে পড়েন, যেন আমিও শুনতে পাই।’

এরপর জামিনের শুনানিতে এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত, ইউটিউব, ফেসবুক ও একাত্তর টেলিভিশনের তিনটি লিংক প্রামাণ্য হিসেবে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, সেগুলো আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। আসামি কী অপরাধ করেছেন, তা নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া আপনার (বিচারক) সামনেও এগুলো উপস্থাপন করা হয়নি। এই ভিডিওগুলো পরীক্ষা না করলে বোঝা যাবে না, আসামি কী অপরাধ করেছেন।’ 

আইনজীবী সমাজী আরও বলেন, ‘এই মামলায় ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭(১) ধারা মানা হয়নি। আসামিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ‍্যে আদালতে হাজির করা হয়নি। রমনা থানায় যিনি মামলা করেছেন, তিনি এই ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য। আসামি যদি কোনো অপরাধ করেও থাকেন, তাহলে তা দেখার প্রথম দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কেন না আসামির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ৩১ ও ৩৫ ধারায় মামলা হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, মামলার বাদি এই আইনজীবী কি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস‍্য, না রাষ্ট্রের কোনো কর্মচারী? প্রাইমারি রেসপনসিবিলিটি কার? এ ধরনের অভিযোগ তো স্টেটের কাঁধে পড়ে। এ খবরে একজন ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হন কী করে? তিনি কীভাবে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ হলেন? আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর বিষয়ে প্রতিকার চাওয়া বা অভিযোগ দেওয়ার অধিকার কীভাবে বাদীর হলো?’

আইনজীবী সমাজী শুনানিতে আরও বলেন, ‘আসামী যদি কোনো ব্যক্তির ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ইচ্ছাকৃত বা জ্ঞাতসারে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক, ভীতিপ্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে কোনো ব্যক্তিকে অপমান, অপদস্ত বা হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে সেটা অপরাধ হয়। এখানে মামলার বাদীকে কীভাবে হেয় করা হলো?’

আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘প্রসিকিউশন কেইস ওয়েল ফাউন্ডেড নয়। সেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় আসামি জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন। এই আমার শুনানি। আপনি যা আদেশ দেবেন, আমরা মাথা পেতে নেব।’

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কমকর্তা (জিআরও) নিজাম উদ্দিন ফকির জামিনের বিরোধীতা করে শুনানি শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আসামি মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে স্বাধীনতার ওপর আঘাত করেছেন। ৩০ লাখ শহীদের ওপর আঘাত হানা হয়েছে। রাষ্ট্রকে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় প্রতিবন্ধী বাসন্তীকে ছেঁড়া জাল পরিয়ে যেভাবে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করা হয়, একইভাবে এখানেও স্বাধীনতা দিবসে একটি শিশুকে দিয়ে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। আসামি সদ্য ধৃত, এই মুহূর্তে জামিন পেলে পলাতক হতে পারেন।’ জামিনে আপত্তি আছে—এই বলে তিনি শুনানি শেষ করেন।

এরপর বিচারক বলেন, ‘উভয়পক্ষের শুনানি শুনলাম। এখন আদেশ দিচ্ছি।’ এ বলে বিচারক বলেন, ‘জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা হলো। আসামি সিডব্লিউমূলে (কাস্টোডি ওয়ারেন্ট) কারাগারে যাবে।’

এ সময় আসামি সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস কাঠগড়ায় নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একে একে আইনজীবী, সাংবাদিকরা আদালত থেকে বের হয়ে যান। সবাই বের হওয়ার ১৫ মিনিট পর শামসুজ্জামানকে আদালত থেকে গারদ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তাকে প্রিজনভ্যানে করে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।  

গতকাল বুধবার (২৯ মার্চ) রাতে রাজধানীর রমনা থানায় মামলাটি করেন আবদুল মশিউর মালেক নামে একজন আইনজীবী। মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, পত্রিকাটির নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস, সহযোগী একজন ক্যামেরাম্যান ও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে নেওয়া হয়। একই রাতে শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাজধানীর তেজগাঁও থানায়ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা হয়। মামলাটি করেন সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া নামে যুবলীগের এক নেতা। তবে এই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।

প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে গত ২৬ মার্চ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনের কিছু উদ্ধৃতি নিয়ে একটি গ্রাফিক‍্যাল ‘কার্ড’ তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশ হয়। ওই কার্ডে একটি শিশুকে ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। জাকির হোসেন নামে একজনের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই কার্ডে লেখা হয়, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়ে কী করুম? বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’

এই বক্তব‍্য নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। পরে একাত্তর টিভির একটি প্রতিবেদনে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি উদ্দেশপ্রণোদিত ও সাজানো বলে দাবি করা হয়। শিশুটির বরাতে বলা হয়, ‘প্রথম আলোর সাংবাদিক তার হাতে ১০ টাকা দিয়ে এ ছবি তুলেছে।’

প্রথম আলো দাবি করে, ‘পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় ছবি এবং উদ্ধৃতির মধ‍্যে অসংগতির বিষয়টি তাদের নজরে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে কার্ডটি সরিয়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি সংশোধনও করা হয়। এরপর সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখ করে পরে তা আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। তারা দাবি করে, প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি ওই উদ্ধৃতিটি ওই শিশুর। তারা উল্লেখ করে, প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের।’

এ ঘটনায় আজ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘স্বাধীনতার দিনটি আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করি। সেই দিন তথ্যভিত্তিক নয়—এমন সংবাদ প্রকাশ করে একটি পত্রিকা। যেভাবে বাংলাদেশ এগিয়েছে, সেটাকে কটূক্তি করে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেজন্য পুলিশের একটি দল সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিলেও এ ঘটনায় সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা হচ্ছে, কয়েকটি মামলা ইতোমধ্যে হয়েছে। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, ‘মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা হয়েছে, সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে নয়।’

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ২৬ তারিখ অনলাইনে (প্রথম আলোর) যে সংবাদটি পরিবেশন করা হয়েছে, এটি অবশ্যই রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে। স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে…, জাতীয় স্মৃতিসৌধ আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, সেখানে একটা ছেলেকে ১০ টাকা দিয়ে ফুসলিয়ে তাকে দিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সে যেটি বলেনি, সেটি প্রচার করা হয়েছে। এটি ঠিক হয়নি বলেই তো তারা (নিউজ) সরিয়ে নিয়েছে। এখানে অবশ্যই রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে।’

এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি ‘পলিটিক্যালি মোটিভেটেড’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘নবীনগরে একটা বাচ্চার হাতে ১০ টাকা দিয়ে স্বাধীনতা নিয়ে তার মন্তব্য নেওয়া হয়েছে। ছেলের নাম সবুজ। তাকে বানানো হয়েছে জাকির হোসেন। ছেলে স্কুলের ছাত্র, তাকে বানানো হয়েছে দিনমজুর।’