বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস হয় স্কুলে, নিয়োগে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/02/19/photo-1487482386.jpg)
একটি বেসরকারি স্কুলের দুটি কক্ষে অফিস। আর ওই স্কুলেই শিক্ষকদের আবাসস্থলে ছাত্রাবাস। এভাবেই চলছে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) কার্যক্রম।
২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় রাবিপ্রবির। কিন্তু পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র বিরোধিতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করা যায়নি। এরপর বহু আন্দোলন, কাঠখড় পোড়ানোর পর প্রায় দুই বছরের সেশনজট মাথায় নিয়ে ২০১৫ সালে দুটি শ্রেণিকক্ষে প্রথম ব্যাচের শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়।
কথা ছিল, শিগগিরই নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাবে পাহাড়ের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি। কিন্তু বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় রাবিপ্রবির মুখ থুবড়ে পড়ার চিত্র। রাবিপ্রবির পরে চালু হয়ে নানা আন্দোলন, পরিস্থিতি মোকাবিলা করে শক্ত ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য (ভিসি) নিয়োগ, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে নজিরবিহীন স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনিয়মের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষ নেই। আর এই ব্যর্থতার কারণেই তৈরি হয়েছে সংকট।
শুরুতেই হ-য-ব-র-ল
বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর পরপরই প্রথম চাহিদা ছিল নিজস্ব ভবন বা শ্রেণিকক্ষের। কিন্তু কোনোরকম শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থা ছাড়াই ব্যবস্থাপনা ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে ১০০ শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। এরই মধ্যে দুই ব্যাচে ১০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে।
এই শিক্ষার্থীদের স্থানীয় শাহ বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করতে হয়। একটি ব্যাচ ক্লাস করলে অন্য ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
এই দাঁড়ানোর পালা শেষ হলে শিক্ষার্থীদের আরেকটি ক্লাস করার জন্য ছুটতে হয় রাঙামাটি শহরের আরেক প্রান্তে অবস্থিত ভেদভেদী উন্নয়ন বোর্ড রেস্টহাউসে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, রাবিপ্রবির ক্যাম্পাস রাঙামাটিতে হলেও ভর্তি-সংক্রান্ত সব কাজ, এমনকি ভর্তি পরীক্ষাও হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ অনুষদে।
বিতর্কের কেন্দ্রে ভিসি
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্তের পর উপাচার্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের (ইউএনডিপি) পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধান কিংবা ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালনের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমার। সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই শিক্ষক অনভিজ্ঞতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে গতি আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর এ জন্য তাঁর অনভিজ্ঞতা, অবহেলা এবং উদাসীনতাকেই দায়ী করলেন বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে নিয়োগ করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
এ ছাড়া শুধু ‘চাকমা’জনগোষ্ঠী থেকে নিয়োগের কারণে এরই মধ্যে উপাচার্যের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা,আঞ্চলিকতা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছে পার্বত্য-বাঙালি ছাত্র পরিষদ। সংগঠনটি ভিসির অপসারণ দাবিতে রাঙামাটি শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।
ছাত্রসংগঠনটির অভিযোগ, ভিসি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি, মারমা, ত্রিপুরাসহ অন্য সব জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে এবং নিজের স্বজনদের নিয়োগ দিয়ে নিজের অযোগ্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
উপ-রেজিস্ট্রারের নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ২৪টি পদে নিয়োগের জন্য ২৬ জুন-২০১৬ তারিখে একটি ইংরেজি দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরই মধ্যে ২১টি পদে নিয়োগও দেওয়া হয়েছে। সব পদেই লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষেই দেওয়া হয়েছে নিয়োগ। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে উপ-রেজিস্ট্রার পদে অঞ্জন কুমার চাকমাকে নিয়োগ দেওয়া হয় কোনো প্রকার লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই, সরাসরি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই! শুধু তাই নয়, সে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন, সেই একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অন্যান্য পদের ভাইভা বোর্ডেও ছিলেন এই ‘ভাগ্যবান’ উপ-রেজিস্ট্রার! অথচ এই পদে উচ্চতর ডিগ্রিধারী এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থী থাকলেও তাঁদের উপেক্ষা করা হয়েছে অঞ্জন কুমার চাকমাকে নিতে।
নেই ‘অ-উপজাতীয় কোটা’!
অবশেষে বহুল প্রতীক্ষার পর রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলেও ‘অজ্ঞাত’ কারণে বারবারই দেরিতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি ২৮ জানুয়ারি শনিবার ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে নিজেদের ওয়েবসাইটে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপজাতীয় কোটার পাশাপাশি ‘অ-উপজাতীয় কোটা’ চালু থাকরলেও পাহাড়ের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে উপজাতীয়, পোষ্য এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের কথা জানানো হলেও পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারি বাঙালিদের জন্য কোনো কোটাই সংরক্ষণ করা হয়নি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার অঞ্জন কুমার চাকমা স্বাক্ষরিত ভর্তি বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশের পর বিভিন্ন মহল থেকেই তীব্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
এই ব্যাপারে আরাফাত নামে রাঙামাটিরই এক ছাত্র ফোন করে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, মনির নামে এক ভাই প্রাণ হারিয়েছে, আজ আমাদের জন্যই কোনো কোটা নেই ! এতটা অকৃতজ্ঞ হয় কী করে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন?’
কারাবন্দি ছাত্রজীবন!
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এর শিক্ষার্থীদের জীবন অনেকটাই কয়েদিদের মতোই। শাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণিকক্ষে দিনে দুটি বা তিনটি ক্লাস আর বাকিটা সময় স্কুলের শিক্ষক কোয়ার্টারে স্থাপিত অস্থায়ী ছাত্রাবাসে পুলিশ প্রহরায় বন্দি জীবন! কোনো জাতীয় দিবস কিংবা জাতীয় কোনো প্রতিযোগিতা, এমনকি স্থানীয় কোনো বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন কিংবা অংশগ্রহণেও শিক্ষার্থীদের ওপর জারি আছে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। শিক্ষক হিসেবে মাত্র চার/পাঁচজন। একেকজন দায়িত্ব পালন করছেন অসংখ্য পদের। কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জুয়েল শিকদার একাধারে প্রক্টরিয়াল বডির সভাপতি, হাউস টিউটর, বিভাগীয় প্রধান এবং শিক্ষক পরিষদেরও সভাপতি! একই অবস্থা অন্য শিক্ষকদের বেলায়ও। আবার ছাত্রদের ওপর খবরদারির কমতি নেই। এক ছাত্রকে তুচ্ছ অভিযোগে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে তিনবার!
ক্যাম্পাসের খবর নেই, একের পর এক বাড়িভাড়া
প্রতিষ্ঠার তিন বছর পরও এখনো রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাসের কার্যক্রমের আশাব্যঞ্জক কোনো চিত্র দেখা যাচ্ছে না। রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়কে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হলেও এখন ভূমির মালিকদের সঙ্গে ক্ষতিপূরণের টাকার বিষয় নিয়ে আইনি জটিলতার অবসান না হওয়ায় থমকে আছে কার্যক্রম। ফলে ঠিক কবে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার নিজস্ব ক্যাম্পাসের কাজ শুরু করবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়! নিজস্ব ক্যাম্পাসের কাজ থমকে থাকলেও থেমে নেই নতুন নতুন ভবন ভাড়া নেওয়ার প্রক্রিয়া। রাঙামাটিতে উন্নয়ন বোর্ডের একটি ভবন ভাড়ায় নিয়ে অফিশিয়াল কার্যক্রম, শাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টার ভাড়া নিয়ে ছাত্রাবাস, স্কুল কক্ষ ভাড়া নিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম এবং বেইন টেক্সটাইল মালিকের বাসা ভাড়া নিয়ে চলছে ছাত্রীদের হোস্টেলের কাজ। সেইসঙ্গে ঢাকায় লিয়াজোঁ অফিসও চলছে ভাড়া বাসায়। ভাড়ার টাকা বাবদ শাহ স্কুলকে প্রতি মাসে ৫৪ হাজার টাকা, বেইন টেক্সটাইলকে ২৭ হাজার টাকা, ঢাকায় প্রায় ২৭ হাজার টাকা প্রদান করতে হচ্ছে।
খাগড়াছড়ির লোকজন প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলেও এখানে নিয়োগে বঞ্চিত হচ্ছে রাঙামাটি ও বান্দরবানবাসী। এখন পর্যন্ত যে অর্ধশতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে শতকরা আশিজনের বাড়িই খাগড়াছড়ি জেলায়! বান্দরবান থেকে তেমন কাউকেই নিয়োগ দেওয়া হয়নি। রাঙামাটি থেকেও আছে মাত্র তিন/চারজন। ভিসির নিজের জেলা খাগড়াছড়ি হওয়ার কারণেই এ রকমের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ উঠছে। শুধু নিয়োগই নয়, ভর্তির ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি, এমন শিক্ষার্থীদের ভর্তি করার সুস্পষ্ট অভিযোগ আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এরই মধ্যে পূরণকৃত গুরুত্বপূর্ণ পদের সবকটিতেই দায়িত্বে খাগড়াছড়ির লোকজন। অথচ রাঙামাটি জেলার মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম আর ত্যাগের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা বা সম্মান দেখাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান প্রশাসন। আর বিবেচনাতেই রাখা হচ্ছে না আরেক পার্বত্য জেলা বান্দরবানকে। এ নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা আছে সেখানেও। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসিসহ প্রায় সব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাড়ি খাগড়াছড়ি হওয়ায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির পিকনিকও হয়েছে খাগড়াছড়িতে! এ যেন নিজেদের বাড়িতেই বেড়াতে যাওয়া।
সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ
নতুন প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তা হলো, সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ। নিয়োগ এবং ভর্তিতে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে ভুক্তভোগীরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এরই মধ্যে নিয়োগ হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি পদেও কোনো মারমা, ত্রিপুরা কিংবা বাঙালিকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এমনকি অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাউকেই নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার শর্তই ছিল স্থানীয়দের অগ্রাধিকার। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালিদের ইচ্ছাকৃতভাবেই উপেক্ষা করা হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এ ব্যাপারে রাঙামাটি ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ঝিনুক ত্রিপুরা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে বিতর্কিক কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন বর্তমান উপাচার্য। তিনি নিয়োগে চাকমা ছাড়া আর কাউকেই নিয়োগ দিচ্ছেন না। তিনি একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছেন। আমরা ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁর অপসারণ দাবি করছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগ ত্রিপুরাদের যোগ্যতা অনুসারে নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।’
মারমা সাংস্কৃতিক সংস্থার (মাসাস) কেন্দ্রীয় সভাপতি, কাপ্তাই উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অংসুচাইন চৌধুরী বলেন, ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তির আলোকেই পার্বত্য এলাকার সব নিয়োগে সব জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষণ করা আছে। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো একটি সম্প্রদায়কে বেশি নিয়োগ দিলে চুক্তি পরিপন্থী কাজই হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এটা হওয়া উচিত হয়নি। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং দাবি করছি সমতা ও কোটার ভিত্তিতে যেন সব নিয়োগ প্রদান ও ভর্তি করা হয়।’
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও মারমা নেতা অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, এটা উচিত হয়নি। একটি বিশেষ গোষ্ঠী থেকে নিয়োগ না দিয়ে মেধা ও সমতার ভিত্তিতে সব সম্প্রদায় থেকে নিয়োগ দেওয়া উচিত ছিল। কারণ, এটি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়।
এ প্রসঙ্গে পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আলকাচ আল মামুন বলেন, “একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব পদ থাকে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সবকটিতেই শুধু চাকমা জনগোষ্ঠী থেকে নিয়োগ দিয়ে একটি সুপরিকল্পিত নীলনকশা বাস্তবায়নের পথেই এগোচ্ছেন ভিসি। তাকে বহাল রেখে কোনোভাবেই এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পার্বত্য-বাঙালিরা দিনের পর দিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ বাঙালিরা ‘অস্পৃশ্য’, এটা মেনে নেওয়া হবে না।”
ভর্তি ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে অভিযোগ
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা যেন আবেদন করতে না পারে এবং শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগেও বাইরের যোগ্য প্রার্থীদের প্রতিরোধ করার কৌশল হিসেবে নিয়োগ ও ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেশের প্রধান প্রধান প্রচারবহুল জাতীয় দৈনিকগুলোতে না দিয়ে, চট্টগ্রামভিত্তিক স্থানীয় পত্রিকায় এবং প্রচার নেই এমন ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। এর ফলে প্রথম বছর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী আবেদন করেছিল, দ্বিতীয় বছরে তা অনেক কমে যায়। একইভাবে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও পার্বত্য এলাকার বাইরের যোগ্য প্রার্থীদের আবেদনই তেমন জমা পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়টির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছেন, মূলত বাইরের শিক্ষার্থী ও আবেদনকারীরা যেন আসতে না পারে, সে জন্যই কৌশলে এ পদক্ষেপ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
হতাশ স্থানীয়রা
একদিন রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চালুর জন্য গঠিত হয়েছিল রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ। সংগঠনটি ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচি পালন করে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু করতে বাধ্য করে প্রশাসনকে। সেই সংগঠনের আহ্বায়ক সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, “এটি আমাদের স্বপ্নের এবং আকাঙ্ক্ষার বিশ্ববিদ্যালয়। এর সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের আবেগ-অনুভূতি জড়িত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যা করছেন, তা লজ্জা এবং ঘৃণার। আমি অবিলম্বে তাঁকে অপসারণ করার দাবি জানাচ্ছি। তাঁর কার্যক্রমে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়টি হতাশায় পরিণত হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি তাঁকে অপসারণ করা হয়, ততই মঙ্গল। কারণ তিনি খুব কৌশলে দ্রুতই এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি ‘সাম্প্রদায়িক খোঁয়াড়’-এ পরিণত করছেন, এটাকে রুখতে হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ বাস্তবায়নের দাবিতে কাউখালী উপজেলার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানববন্ধনের আয়োজক ছিল সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ। সংগঠনটির আহ্বায়ক জিয়াউর রহমান জুয়েল বলেন, ‘যারা আন্দোলন করল, রক্ত দিল তারা উপেক্ষিত আর যারা বিরোধিতা করল তারাই সব সুবিধা ভোগ করছে, এটা কী ধরনের সিদ্ধান্ত? আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিতে চাই, আমাদের আবার মাঠে নামতে বাধ্য করবেন না।’
পার্বত্য-বাঙালি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘বিষয়টি খুবই দুঃখজনক এবং লজ্জাজনকও বটে। যেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপজাতীয় কোটার পাশাপাশি অ-উপজাতীয় কোটা আছে, সেখানে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কোটা সংরক্ষণ না করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের ‘সাম্প্রদায়িক ও কদর্য’ চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগেও একইভাবে সাম্প্রদায়িক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলব।
পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান আলকাচ আল মামুন বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় চালুর জন্য একদিন আন্দোলন করে এটিকে চালু করতে বাধ্য করেছিল পার্বত্য-বাঙালিরা, এখন একে রক্ষা করতেও মাঠে নামতে বাধ্য করা হচ্ছে আমাদের। এই সাম্প্রদায়িক ভিসি ইউএনডিপি-সন্তু লারমা ও চাকমা রাজার এজেন্ট, তাঁকে দায়িত্বে রেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।’
উপাচার্যের বক্তব্য
ভিসি ড. প্রদানেন্দু। তিনি বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজ ক্যাম্পাসে যেতে দেরি হচ্ছে। আগামী এক মাসের মধ্যেই এ সমস্যার সমাধান হবে। অ-উপজাতীয় কোটা না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সারা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই সার্কুলার দেওয়া হয়েছে। ভর্তি এবং নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘নিয়োগের জন্য পৃথক কমিটি আছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্যরা ও থাকেন। এখানে আমার কিছুই করার নেই। ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি।’ নিয়োগে খাগড়াছড়ির লোকজনকে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘সেখান থেকে বেশি আবেদন পড়েছে। অন্য দুই জেলা থেকে আবেদন না পড়লে আমার কী করার আছে।’ একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী থেকে প্রায় সব নিয়োগ পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মেধার ভিত্তিতে হয়েছে সব।’