গণস্বাস্থ্যে ১১০০ টাকায় ডায়ালাইসিসের কার্যক্রম শুরু
কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া গরিব রোগীদের মাত্র এক হাজার ১০০ টাকায় ডায়ালাইসিসের সুবিধা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার।
আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ২০ রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই সেন্টারের কার্যক্রম শুরু হয়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতি মাসে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস করতে খরচ হয় ৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার। এখানে ডায়ালাইসিস করতে দরিদ্র রোগীদের খরচ পড়বে এক হাজার ১০০ টাকা, মধ্যবিত্ত রোগীদের এক হাজার ৫০০ টাকা। আর উচ্চবিত্তদের তিন হাজার টাকা করে খরচ পড়বে। এ ছাড়া ৫ শতাংশ অতিদরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হবে।
১০০ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন ৫০০ জন রোগীর ডায়ালাইসিস করার সুযোগ থাকছে। ২৪ ঘণ্টা এই সেন্টার চালু থাকবে। এ ছাড়া থাকছেন একজন ক্লিনিক্যাল ডায়েটেশনিস্ট। তিনি ডায়ালাইসিসের সময় রোগীর খাবার কী হবে এবং ডায়ালাইসিস-পরবর্তী সময়ে রোগী কীভাবে তাঁর খাবার ব্যবস্থাপনা করবেন, তার চার্ট তৈরি করে দেবেন। আর এই সেবাটিও থাকছে নির্ধারিত টাকার মধ্যেই।
প্রথম দিনে রোগীদের অভিজ্ঞতা
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডায়ালাইসিস করাতে মিরপুর-১ থেকে ধানমণ্ডিতে এসেছেন রাশেদুল হক সুমন (৪৬)। তাঁকে ডায়ালাইসিস দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেন্টারের কার্যক্রম শুরু হয়। অনুভূতি জানতে চাইলে সুমন বলেন, এক বছর ধরে ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন তিনি। এর আগে প্রায় তিনটি প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস করিয়েছেন। সেগুলোতে খরচ অনেক বেশি। এখানে তাঁর কাছ থেকে প্রতি সেশন ডায়ালাইসিসে ১ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ডায়ালাইসিস খুব ব্যয়বহুল চিকিৎসা। রোগীরা খোঁজে কোথায় স্বল্প খরচ ও ভালো মান পাওয়া যায়। সেই আশাতেই এখানে আসা।
২৫ বছর বয়সী সীমা দাস। তাঁর এক ছেলে আছে। পাঁচ বছর ধরে তিনি কিডনি রোগে ভুগছেন। আড়াই বছর ধরে ডায়ালাইসিস করাতে হচ্ছে তাঁকে। সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। আগে যেখানে ডায়ালাইসিস করাতেন, সেখানে প্রতি সেশনে তিন হাজার টাকা খরচ পড়ত। সপ্তাহে চলে যেত ছয় হাজার টাকা। তবে এখন গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টারে তিনি বিনামূল্যে এই সেবা পাচ্ছেন। বিনামূল্যে সেবা প্রসঙ্গে সীমা বলেন, ‘ডায়ালাইসিস করতে আমার অনেক খরচ পড়ে যেত। আর কুলাতে পারছিলাম না। একটি ছেলে নিয়ে খুব কষ্টে সংসার টানতে হচ্ছে। এখানে বিনা পয়সায় ডায়ালাইসিস করতে পারছি।’
তিন বছর কিডনি রোগে ভোগার পর ছয় মাস ধরে ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন পুষ্প গোমেজ (৫২)। এর আগে স্কয়ার, ল্যাবএইড হাসপাতালে তিনি ডায়ালাইসিস করিয়েছেন। গণস্বাস্থ্যে এসেছেন কম খরচের আশায়।
‘ডায়ালাইসিস করতে করতে সব শেষ হয়ে যায়। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিনই তো ডায়ালাইসিস করাতে হবে। এখানে কম খরচে সেবা পাওয়ার আশায় এসেছি’, বলেন পুষ্প।
চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য
সেন্টারের কার্যক্রম নিয়ে জানতে চাইলে নেফ্রোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আবদুল হামিদ বলেন, ‘ডায়ালাইসিস একটি গ্রিক শব্দ। যাদের কিডনি বিকল হয়ে যায় বা একপর্যায়ে কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়, শরীর পানি, বর্জ্য ইত্যাদি বের করতে পারে না, তখন ডায়ালাইসিস মেশিনের সাহায্য দরকার হয়। সাধারণত শরীরে ফিস্টুলা বা এক্সেস ক্যাথেডার করে শরীর থেকে দূষিত রক্ত নিয়ে এসে, মেশিনের সাহায্য রক্তকে পরিশোধিত করে শুদ্ধ রক্ত ভেতরে ঢোকানো হয়। এভাবে আমরা কাজটি করি।’
বর্তমানে সেন্টারটিতে সাতজন চিকিৎসক আছেন জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, এটিতে নার্স রয়েছেন ৩০ জন। আর টেকনিশিয়ান আছেন ৩৪ জন। এখানে রোগীর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবই এই খরচের মধ্যে করা হবে। খাবারের মধ্যে থাকছে গণস্বাস্থ্যের নিজস্ব তৈরি বনরুটি, ডিম ও চিকেন ডার্ম স্টিক।
ডায়ালাইসিস সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. মহিবুল্লাহ জানান, ‘আজকে থেকে আমরা সেন্টার শুরু করলাম। আমরা প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে চারটি সেশন চালাতে চাই। আশা করছি আগামী সপ্তাহ থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারব। আর জরুরি রোগীদের জন্য ২৪ ঘণ্টা ডায়ালাইসিস সেবার সুযোগ রয়েছে।’
‘যদি বেশি রাত হয়ে যায়, তাহলে রোগীকে গাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে- এমন একটি পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে। আমরা চাই নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের লোকেরা আমাদের উদ্যোগ দেখুক এবং এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণে ব্যবস্থা নিক।’
মহিবুল্লাহ আরো বলেন, ‘আমাদের গণস্বাস্থ্যের লোকেরা বলি শত ফুল ফুটতে দাও। আমাদের পক্ষে তো সারা দেশ কাভার করা সম্ভব নয়। সরকার বা নীতি-নির্ধারণী লোকেরা যদি এই উদ্যোগ দেখে এ ধরনের কাজ করতে পারে, তাহলে সুলভমূল্যে মানুষ আরো সেবা পেতে পারে। আমরা তাদের সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান শেয়ার করতে চাই।’
স্বল্পমূল্যে ডায়ালাইসিস করা নিয়ে জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ক্রস সাবসিডির (একেক বিত্তের লোকজনের কাছ থেকে একেক পরিমাণ অর্থ নেওয়া) মাধ্যমে আমরা এটি করতে পারছি। ধনীদের কাছ থেকে আমরা একটু বেশি পয়সা নিচ্ছি। গরিবদের চিকিৎসায় ব্যয় করছি।’ সবচেয়ে বড় কথা হলো, ডায়ালাইসিস খুব ব্যয়বহুল। এর অক্ষমতার জন্য দায়ী সরকার। যন্ত্রপাতির ওপর ট্যাক্স কমিয়ে, হাসপাতালের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে, ওষুধপত্রের দাম কমিয়ে এর খরচ কমানো সম্ভব হয়।’
‘সরকার স্যানডর নামের একটি কোম্পানিকে ১৭০০ টাকা সাবসিডি দিচ্ছে। আর রোগীদের সেখানে দিতে হচ্ছে ৪০০ টাকা। সরকারের কাছে আমাদের একটি চাওয়া, গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টারের রোগীদের ৬০০ টাকা সাবসিডি দেওয়া হোক।’