রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় দেশে ফিরলেন দুজন

পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনতে দালালের হাত ধরে ট্রলারে সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। কিন্তু একসময় বুঝতে পারেন নিজেই জীবনকেই মৃত্যুর মুখে ফেলে দিয়েছেন। ‘মুক্তির আশায়’ টানা আড়াই মাস গভীর সমুদ্রে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছেন। নিজের চোখের সামনে মৃত মানুষকে সাগরে ভাসিয়ে দিতে দেখেছেন। তার পর কিছুদিন মিয়ানমারে ‘বন্দিদশায়’ কাটিয়েছেন। আবার সেই ‘বন্দিশালা’ থেকে পালিয়ে ফিরে এসেছেন মায়ের কোলে, পরিবারের কাছে। পেয়েছেন মুক্তির স্বাদ।
মাগুরার ডেফুলিয়ার ইমরান শেখ ও তাঁর মামাতো ভাই শাহিন বিশ্বাসের জীবনের গত তিন মাসের অভিজ্ঞতা এটি। গতকাল মঙ্গলবার তাঁরা বাড়ি ফিরে আসেন।
শাহীন ও ইমরান ফিরলেও সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী মাগুরার শালিখা উপজেলার সাতজন এবং পৌর এলাকার ডেফুলিয়ার একজনসহ মোট আটজন এখনো নিখোঁজ। মানবপাচার করার অভিযোগে ডেফুলিয়ার কামরুল ও রবিউল নামের দুজনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে দালাল চক্রের মূল হোতারা এখনো রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গতকাল বিকেলে ডেফুলিয়ায় ইমরানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় অনেক মানুষের ভিড়। ইমরানের মা হাসিনা বেগমসহ তাঁর স্বজনরা তাঁকে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। একই চিত্র এলাকার পশ্চিমপাড়ার শাহিনের বাড়িতেও।
দালালের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ইমরান শেখ (২৩) ও শাহিন বিশ্বাস (২২) গত ১২ এপ্রিল বাড়ি থেকে রওনা দেন। একইভাবে এপ্রিল মাসের প্রথমে একই গ্রামের দুলাল মোল্লার ছেলে ইমরান মোল্লা (৩০) নিখোঁজ হন। কিছু দিন পরে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশিদের থাইল্যান্ডে গোপন ক্যাম্পে আটকে অবর্ণনীয় নির্যাতন ও হত্যার পর গণকবরে পুতে রাখার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চলে আহাজারি।
পাচার হওয়া ইমরান শেখ জানান, ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করে ভালোই চলছিল তাঁর সংসার। স্থানীয় কামরুল ও রবিউল দালালের খপ্পরে পড়ে অধিক আয়ের আশায় সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে রাজি হন। রাজ্জাক নামের এক দালালকে ইমরান ও শাহিন ৫০ হাজার টাকা করে মোট এক লাখ টাকা দেন। বাকি টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছে চাকরি পাওয়ার পর পরিশোধ করার শর্তে রাজি হন।
ইমরান জানান, গত ১২ এপ্রিল রাজ্জাক তাঁদের ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পাঠায়। সন্ধ্যায় আরেক দালাল তাঁদের চট্টগ্রাম নিয়ে যায়। পরের দিন কক্সবাজার টেকনাফে নিয়ে একটি অন্ধকার ঘরে আরো তিনজনের সঙ্গে আটক রাখে। ওই দিন রাতে ছোট একটি ট্রলারে আরো ১৫-১৬ জনের সঙ্গে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দালালরা। পরের দিন ভোরে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় আরো ১০-১২টি ট্রলার এক হয়ে সমুদ্রপথে রওনা দেয়। এর পরই দালালরা জানায়, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ার সীমান্তরক্ষী বাহিনী ঢুকতে দিচ্ছে না।
এর পর থেকেই সমুদ্রপথে কেটে যায় আড়াই মাস। প্রতিদিন সামান্য ভাত, দুটি শুকনা মরিচ এবং জর্দ্দার কোটায় এক কাপ পরিমাণ পানি খেতে দিত পাচারকারীরা। বাড়তি পানি বা ভাত চাইলে চলত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
ইমরান জানান, মোটা ফিতা ও রড এবং পিস্তলের বাট দিয়ে মারধর করত। পাচারকারীদের নির্যাতনে নরসিংদী জেলার এক যুবক মারা যায়। তাঁকে কোনো রকম জানাজা পড়িয়ে একটি লুঙ্গি পেঁচিয়ে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।
ইমরান জানান, এক সময় মিয়ানমারের নৌবাহিনীর হাতে ট্রলারটি ধরা পড়ে। মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক একটি মানবাধিকার সংস্থার ক্যাম্পে রাখা হয় সবাইকে। সেখানে বন্দীদের মতোই রাখা হয় তাঁদের। ক্যাম্প থেকে ১০-১২ দিন পর জীবন বাজি রেখে শাহিনকে নিয়ে পালিয়ে পাহাড়ে অবস্থান নেন ইমরান। কুকুরের ধাওয়া খেয়ে দুই দিন এক রোহিঙ্গা মুসলমানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। পরে ওই রোহিঙ্গা পরিবারের সহযোগিতায় নাফ নদ পাড়ি দিয়ে টেকনাফে প্রবেশ করেন দুই ভাই।
মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘দালালের খপ্পরে পড়ে ডেফুলিয়া গ্রামের পাচার হওয়া ইমরানের ছোট ভাই রাজু শেখ স্থানীয় দুই পাচারকারী কামরুল ও রবিউল ইসলামকে আসামি করে সদর থানায় মামলা করেন। গত ২৩ মে মামলাটি দায়ের করা হয়। পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামিদের আটক করেছে। অন্যদিকে শাহিন ও ইমরান পালিয়ে বাড়িতে ফিরে আসায় গতকাল মঙ্গলবার ১৬৪ ধারায় আদালতে তাঁদের জবানবন্দি রেকর্ড করে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে এখনো মাগুরা পৌর এলাকার টিটুল সরদার (১৮), শরাফত হোসেন (২৫), ইসলাম আলী, শালিখার হাজরাহাটি গ্রামের শুকুর আলী, দীঘি গ্রামের ইকরাম হোসেন (৪৮), আল আমীন (১৮), দিঘল গ্রামের নান্নু মিয়া (৩৫) এবং সদর উপজেলার ডেফুলিয়া গ্রামের ইমরান মোল্লা (৩০)।