ত্রাণ ‘পর্যাপ্ত’, তবু ভয়!
রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের সরবরাহ রয়েছে বলে দাবি করেছে জেলা প্রশাসন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ঘুরেও ত্রাণের প্রকট কোনো সমস্যা চোখে পড়েনি। বেসরকারিভাবেও মানুষ এগিয়ে আসছে দুর্গতদের পাশে। ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের ঘাটতি হয়তো আছে।
কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষগুলোর ভয় অন্য জায়গায়। কবে বাড়ি ফিরবেন, সবকিছু হারিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কি না, যেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন প্রতিনিয়ত তাঁদের তাড়া করে ফিরছে।
গতকাল রোববার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাঙামাটি শহরের পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করে এবং সেখানে আশ্রয় নেওয়া ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেল।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাঙামাটি শহরের ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে এরই মধ্যে ঠাঁই নিয়েছেন ৫০০ পরিবারের দুই হাজার ৫৯১ জন মানুষ। তবে তাঁদের সবাই একই মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত নন। কেউ বা সর্বস্ব হারিয়েছেন, আবার কেউ বা হারানোর ভয়ে কিংবা শঙ্কায় আশ্রয় নিয়েছেন এসব কেন্দ্রে। তাই সহায়তাও মিলছে ভিন্ন ভিন্নভাবে।
জেলা ত্রাণ সমন্বয় কমিটি রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছে। সেখানে জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা রয়েছেন। সাতজন নির্বাহী হাকিম এর পর্যবেক্ষণ করছেন। রাঙামাটি পৌরসভার ক্ষতিগ্রস্ত ছয়টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও একজন করে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার সমন্বয়ে পরিচালিত হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো। আবার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও বর্তেছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ওপর। ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রের চারটি পুলিশ, সাতটি সেনাবাহিনী, চারটি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও চারটি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি তদারক করছে।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য এবং অর্থ আছে, যা বিলি করা হচ্ছে এবং হবে। একই সঙ্গে এঁদের পুনর্বাসনেও কাজে লাগানো হবে। রাঙামাটির বাজার পরিস্থিতিও স্বাভাবিক।’
আশ্রয়কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা রাঙামাটি পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান বাবু বলেন, ‘আশ্রিতদের খাবার এবং থাকার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই করা হয়েছে। তাঁদের কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। সমস্যা হলে আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি।’
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গতকাল জানানো হয়েছে, সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৫০০ টন চাল, পর্যাপ্ত পরিমাণ ঢেউটিন এবং নগদ ৬৫ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। কিছু টাকা নিহতদের স্বজনদের দেওয়া হয়েছে, বাকি টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যয় করা হবে।
রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী জানিয়েছেন, আশ্রিতদের তালিকা চূড়ান্ত করে তাদের বিশেষ বিশেষ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। পাঁচ বছরের নিচের শিশু, দুগ্ধপোষ্য, গর্ভবতী মায়েদেরও আলাদা ক্যাটাগরি করে সহযোগিতা করা হচ্ছে। আবার যারা শিক্ষার্থী, শিশুশ্রেণি থেকে কলেজ পর্যন্ত, তাদের বিনামূল্যে বইয়ের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
বেসরকারি উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন অনেকেই। এরই মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ‘মানবিক সাহায্য-সংক্রান্ত তহবিল’ (চলতি হিসাব নম্বর-২০৫০২০১০১০০২৮১৩০৪, রাঙামাটি শাখা) হিসাব খুলেছে। এতে প্রথম দিনেই রাঙামাটি লঞ্চ মালিক সমিতি ৫০ হাজার টাকা, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ৬১ হাজার, মৎস্য বিভাগ ৩৪ হাজার, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকা জমা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, অসংখ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন সেখানে ভিড় করেছে ত্রাণ সহায়তা করতে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে ত্রাণ নিয়ন্ত্রণ সেল।
জেলা প্রশাসকের ব্যক্তিগত পক্ষ থেকেও আজ সোমবার আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত নারীদের মধ্যে শাড়ি, পিনন (আদিবাসী পোশাক), সাবান বিতরণ করা হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে, কাউখালীতে একটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় সেখানে আশ্রিতরা চলে গেছেন। কাপ্তাইয়ে তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও এখন সেখানে একটি কেন্দ্র ছাড়া বাকিগুলো থেকে আশ্রিতরা বাড়ি ফিরে গেছেন।
বাজার পর্যবেক্ষণে প্রশাসন
এদিকে রাঙামাটির বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে কাজ শুরু করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও মনিটরিং সেল। শহরের বনরূপা, রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি ও কলেজগেট এলাকা পরিদর্শন করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমানে শহরে চাল ৩৫-৪০ টাকা, আলু ২৩/২৫, কাঁচামরিচ ১০০/১২০, মুড়ি ৭২, ঢেঁড়স ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এর মধ্যে শহরের তবলছড়ি বাজারে ছদ্মবেশী নির্বাহী হাকিম সোহেল রানা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সবজি বিক্রিতে বাড়তি মূল্য নেওয়ায় এক ব্যবসায়ীকে সাত দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
এদিকে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত রাঙামাটি-কাপ্তাই নৌরুটে লঞ্চ যোগাযোগে কোনো ভাড়া না নেওয়ার কথাও জানিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। অর্থাৎ লঞ্চে পণ্য পরিবহনে কোনো ভাড়া লাগবে না।
সংকট কেটেছে জ্বালানি তেল-গ্যাসের
রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় দৃশ্যত অচল হয়ে পড়া রাঙামাটির জ্বালানি তেল সরবরাহ বিকল্প উপায়ে স্বাভাবিক করা হয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জ্বালানি তেল বিপণনকারী কোম্পানি গত দুদিনে রাঙামাটিতে প্রায় ৩০ হাজার লিটার তেল সরবরাহ করেছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। গত দু’দিনে রাঙামাটির হিলভিউ পাম্প আট হাজার লিটার অকটেন, এস এন পাম্প নয় হাজার লিটার অকটেন, নন্দী ট্রেডার্স দুই হাজার লিটার অকটেন, ছয়শ লিটার কেরোসিন, দুই হাজার ছয়শ লিটার ডিজেল সংগ্রহ করেছে।
আবার বৃষ্টি, আবার ভয়
এদিকে রোববার রাত থেকে রাঙামাটিতে আবার শুরু হয় বৃষ্টি। সোমবার সকাল থেকে আবার বাড়তে শুরু করে বৃষ্টির মাত্রা। ফলে জেলা প্রশাসন, পৌরসভা এবং ফায়ার সার্ভিসের উদ্যোগে শুরু করা হয় মাইকিং। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি স্থাপনকারীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য এ সময় বারবার আহ্বান জানানো হয়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও বাড়তে থাকে ভিড়।
ওমদামিয়া হিল পৌর জুনিয়ার হাই স্কুল আশ্রয়কেন্দ্রে আসা জরিমন বেগম বলেন, ‘গতবার কিছু হয়নি, এবার যদি কিছু হয়, তাই মাইকিং শুনে চলে এসেছি। এখন ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না।’
শহরের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিমুলতলী এলাকার বাসিন্দা দরিদ্র দিনমজুর হাবিব বলেন, ‘আমি জানি না কী করব। বাড়ি মাটির নিচে ধ্বংস হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছি। এখন আবার বৃষ্টি হলে তো সেখানে ফিরে যাওয়া আত্মহত্যার সমান।’
জরিমন কিংবা হাবিবই নয়, উগন্তিপাড়ার শিমুল চাকমার মনেও ভয়। সামান্য বৃষ্টি এলেই বাসার বাইরে চলে আসেন। আবার যদি...। এই চিত্র এখন পুরো রাঙামাটির। বৃষ্টি যেন এখন ভয়ের অন্য নাম পাহাড়ি এই শহরে।