নাগরিক সেবার অনুকরণীয় উদাহরণ পিরোজপুর আদালত
পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ মো. গোলাম কিবরিয়ার হস্তক্ষেপে আদালতের মামলার জট কমতে শুরু হয়েছে। পিরোজপুর আদালতের অধিকাংশ মামলা জমিজমাকেন্দ্রিক। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে অভিজ্ঞ বিচারকের ভূমিকা রয়েছে। বিচারক সংকট থাকলেও মামলা নিষ্পত্তির হার দিন দিন বাড়ছে। ফলে বিচার বিভাগের প্রতি বিচারপ্রার্থীদের আস্থা, বিশ্বাসও বাড়ছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, জেলা আদালতে মোট ১১টি বিচারকের পদ রয়েছে। বর্তমানে নয়জন বিচারক কর্মরত। ছয়টি সহকারী জজ আদালতের মধ্যে দুটি পদ শূন্য আছে। এ ছাড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতে বর্তমানে চারজন ম্যাজিস্ট্রেট কর্মরত এবং চারটি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের পদ শূন্য। এরপরও পিরোজপুর আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার দিন দিন বাড়ছে।
২০১৪ সালে ১০ হাজার ৩৮৫টি মামলা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় পিরোজপুর জজশিপের। বছর শেষে মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৮১৭টিতে। এ বছর নতুন মামলা হয় তিন হাজার ৪৩২টি। আর নিষ্পত্তি হয় দুই হাজার ৫২৭টি। ২০১৫ সালে ১৫ হাজার ৩৩৫টি মামলা নিয়ে বছর শুরু হয়। বছর শেষে মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ হাজার ১৪১টিতে। এ বছর নতুন মামলা হয় চার হাজার ৫০৬টি। আর নিষ্পত্তি হয় চার হাজার ১০৭টি। যা পূর্বের তুলনায় এক হাজার ৫৮০টি বেশি। আর ২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৩৪টি মামলা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তারা। বছর শেষে মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২১ হাজার ৪৪২টিতে। এ বছরে নতুন মামলা হয় পাঁচ হাজার ৪০৮টি। আর নিষ্পত্তি হয় চার হাজার ৫৫৪টি। যা আগের তুলনায় ৪৪৭টি বেশি। মামলার হিসাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিবছর বাড়ছে নতুন মামলার সংখ্যা।
এ ব্যাপারে জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো.শহিদুল হক খান পান্না জানান, পিরোজপুর আদালতে নাগরিক সুবিধার পাশাপাশি বাড়ছে মামলা নিষ্পত্তির হার। ফলে একদিকে যেমন বিচারপ্রার্থীদের বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বাড়ছে, অন্যদিকে আরো নতুন নতুন মামলা হচ্ছে। বিচারক বদলির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভিত্তিতে বিচারক বদলি করলে বিচারকরা ওই জজশিপে বেশি সময় দিতে পারবেন। ফলে আরো অধিক মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব হবে।
অন্যদিকে বিচারকদের শূন্যপদের বিষয়ে পিরোজপুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খান মো. আলাউদ্দিন বলেন, পিরোজপুর জজকোর্ট এখন অনুকরণীয় মডেল। বিচারকের পদ শূন্য থাকলেও বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ মো. গোলাম কিবরিয়া প্রতি মাসে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা ও মামলা মনিটরিং করায় দিন দিন মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ বাড়ছে।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২২ জুলাই বিকেল ৪টার দিকে কয়েদিদের হৈচৈ শুনতে পান জেলা ও দায়রা জজ মো. গোলাম কিবরিয়া। পরে বিষয়টি অনুসন্ধান করে জানতে পারেন হাজতিদের অধিকাংশ সকালে দুটি রুটি খেয়ে আদালতে এসেছেন। কারাগারে নিতে দেরি হলে তাঁরা রাতের খাবারও পাবেন না, এ আশঙ্কায় দ্রুত কারাগারে নেওয়ার জন্য হৈ চৈ করছে।
এর কয়েকদিন পর বিচারক কারাগারে পরিদর্শনে যান। আদালতে হাজতিদের দুপুরের খাবার প্রসঙ্গে জানতে পারেন, আদালতে পাঠানোর সময় হাজতিদের দুপুরের খাবার হিসেবে চিঁড়া-গুড় দেওয়া হয়। আদালত থেকে ফেরার পর হাজতিরা একবারে রাতের খাবার পায়।
পরে জেলা জজ কারা কর্তৃপক্ষ এবং কারাগারে খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদারের সঙ্গে হাজতিদের দুপুরের খাবার আদালতে পাঠানোর বিষয়ে আলাপ করেন। কিন্তু তাঁরা পরিবহন সমস্যার কথা উল্লেখ করে আপত্তি দেখান। পরে আইনগত সহায়তা কমিটির সভায় সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার পর ২০০ বছরের অধিক সময়ের পুরোনো নিয়ম ভেঙে কারাগারে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেন গোলাম কিবরিয়া।
কারা কৃর্তপক্ষের সিন্ধান্তে হাজতিদের জন্য দুপুরের খাবার আদালতের হাজতখানায় সরবরাহ করবেন এবং হাজতখানায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা খাবার পরিবেশনের বিষয়টি তদারকি করবেন। এ ছাড়া হাজতখানায় ভারপ্রাপ্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দুপুরে খাওয়ানোর বিষয়টি সরাসরি তদারকি করবেন। এ উদ্যোগ এরই মধ্যে মাদারীপুরসহ আরো কয়েকটি জেলায় চালু হয়েছে।
পিরোজপুর আদালতের কারাগারের লোকাল ইনচার্জ মো. জালাল উদ্দিন জানান, তাঁর চাকরি জীবনে দুপুরে কারাগারে খাবার সরবরাহ করার বিষয়টি কোথাও দেখেননি। কারাগারে এখন দুপুরের খাবার দেওয়ায় কয়েদিরা সন্তষ্ট হয়েছেন। তিনি আরো জানান, নাগরিক সেবায় এ জেলার অনুসরণ করছে মাদারীপুরসহ আরো কয়েকটি জেলা।
বিচারপ্রার্থীদের মানবিকতার কথা বিবেচনা করে আদালতের বারান্দায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহ এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক সিলিং ফ্যান ও বেঞ্চ দেওয়া হয়েছে।
পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া আদালতের এক বিচারপ্রার্থী এম এম অলি জানান, রোদে পুড়ে, অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসে কখন মামলা উঠবে সেজন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এখন আর সেটি থাকতে হয় না। কিছুটা স্বস্তির ব্যবস্থা হয়েছে আদালতে।