গুলশান হামলার আগে ও পরে যা যা করেছেন র্যাশ
রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ও নব্য জেএমবির অন্যতম রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র্যাশকে শুক্রবার নাটোর থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গুলশান হামলার আগে হামলাকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, অস্ত্র সরবরাহ করা এবং হামলার পরে এক বছর পালিয়ে থেকে আবার নতুন করে জেএমবির বিস্তারে সহযোগিতা করেন র্যাশ।
র্যাশের নানা কার্যক্রম সম্পর্কে আজ শনিবার সাংবাদিকদের বিস্তারিত তথ্য দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম।
ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলায় জীবিতদের ভেতরে বারবার ঘুরেফিরে যার নাম এসেছে তিনি মো. আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা। তাঁকে আমরা খুঁজছিলাম। তাঁকে আমরা নাটোরের সিংড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছি।
মনিরুল ইসলাম বলেন, র্যাশ সম্পর্কে বলা যায়, তিনি এরই মধ্যে হলি আর্টিজান হামলায় যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পাশাপাশি এই ঘটনায় অন্যতম প্রধান সাক্ষী তাহরীম কাদের, এই মামলায় যিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাতে রাশেদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। গ্রেপ্তারের পর র্যাশকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
যেভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে র্যাশ
মো. আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ যেভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন সে সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করেন মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, র্যাশ গত বছর রাজশাহীতে পড়াশোনা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তাঁর সঙ্গে শরীফুল ইসলাম খালেদের পরিচয় হয় এবং ভালো সম্পর্কও তৈরি হয়। যেহেতু তামিম চৌধুরীর সঙ্গে শরীফুল ইসলাম খালেদের ভালো যোগাযোগ ছিল তো সেই কারণে খালেদ তাঁকে রিক্রুট করে। এরপর তাঁর যে কথিত জিহাদি ভিডিও তা দেখিয়ে তাঁকে তামিমের কাছে পৌঁছে দেয়। আর তামিম খুব বিশ্বস্ত হিসেবে তাঁকে (র্যাশ) কাছাকাছি রাখে। বড় কোনো পদ না দিলেও তামিমের খুব কাছাকাছি থাকে র্যাশ। মূলত ভিডিও দেখেই সে রেডিক্যালাইজড হয়। অর্থাৎ কথিত জিহাদের প্রতি তাঁর যে আকর্ষণ তা দেখে তামিম চৌধুরী তাঁকে বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহার করেন। এই কাজগুলোর মধ্যে যেমন যে জঙ্গিরা ঘর ছাড়েন তাদের র্যাশ রিসিভ করে মিরপুরের বাসায় রাখেন এবং তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন।’
হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন র্যাশ
র্যাশ গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারীদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন মনিরুল ইসলাম।
র্যাশকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘হলি আর্টিজানের ঘটনার আগে গ্রেনেড কীভাবে ছুড়তে হয়, তাঁর প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং দেওয়ার জন্য রোহান ইমতিয়াজসহ তিনজনকে বুড়িগঙ্গার পাড়ে নিয়ে যান র্যাশ। প্রকৃত গ্রেনেড কীভাবে ছুড়তে হয় তাঁর একটা প্র্যাকটিস করেন পানিতে। সে সময় রোহান ইমতিয়াজের পায়ে একটা স্প্লিটার লাগে। তিনি আহত হন। পরে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে ঠিক করেন।’
হলি আর্টিজানের হামলায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল র্যাশের
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘হলি আর্টিজানের ঘটনায় তাঁরও (র্যাশ) অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। প্রাথমিকভাবে তাঁকেও সিলেক্ট করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁকে বাদ দিয়ে বাকি পাঁচজনকে সিলেক্ট করা হয়। তখন তিনি তামিম চৌধুরীকে জিজ্ঞাসা করলে তামিম চৌধুরী তাঁকে জানান, পরে অন্য কাজ করাবে।’
হলি আর্টিজানের হামলার আগে যেভাবে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল র্যাশ
হলি আর্টিজানের হামলার সময় অস্ত্র প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ছোট মিজানের কথা আমরা এর আগে বলেছি। তিনি এবং বড় মিজান এঁরা সোহেল মাহফুজের তত্ত্বাবধানে হামলার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করে দেন। ছোট মিজান হলি আর্টিজানের ঘটনার কিছু দিন আগে ঢাকায় আসেন। ফিরে যাওয়ার সময় তাঁকে অস্ত্র পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে এই রাশেদ ওরফে র্যাশকেও পাঠানো হয় অস্ত্র নিয়ে আসার জন্য। সেখানে যাওয়ার পর রাশেদকে চারটি নাইন এমএম পিস্তল, আটটি ম্যাগাজিন ও ৩০টি গুলি দেওয়া হয়। তিনি একটি পিস্তল কোমরে এবং বাকিগুলো একটি আমের ঝুড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। নিয়ে আসার পর তা কল্যাণপুরের বাসায় ওঠান। ওইখান থেকে মূলত বাশারুজ্জামান চকলেট সেগুলো বসুন্ধরার বাসাতে নিয়ে যান।’
তামিম চৌধুরী মারা যাওয়ায় বড় পদ পাননি র্যাশ
সংগঠনে র্যাশের বড় একটি পদ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তামিম চৌধুরী মারা যাওয়ার কারণে সেটি আর পাওয়া হয়নি র্যাশ ওরফে রাশেদের।
এ প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘র্যাশকে নিয়ে তামিম চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল যে তাঁকে আরো একটু বড় পদে দেবেন। তিনি তামিম চৌধুরীর স্নেহভাজন এবং ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবে তামিম চৌধুরী মারা যাওয়ার পরে তাঁর আর পদোন্নতি হয়নি। তাঁর পরিবর্তে দেখা যায় যে অন্যরা এগিয়ে গেছে। এরপর র্যাশ ওরফে রাশেদ যারা পুরোনো সংগঠক ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুনরায় আবার সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করে আসছিলেন।’
জঙ্গিদের বাসা ভাড়া ও সাজানোর দেখাশোনা করতেন র্যাশ
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আজিমপুরে তানভীর কাদের যেখানে মারা যান ওই বাসাতে র্যাশই তাঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বসুন্ধরার বাসাটি যখন ঠিক করা হয় তানভীর কাদেরির নামে, তখন ওই বাসার ফার্নিচার র্যাশই ঠিক করে দেন কী কী লাগবে। এ সময় আকিকুফ জামান যে কল্যাণপুরে নিহত হয়েছে, এই দুজনে মিলে শ্যাওড়াপাড়ার ফার্নিচারের দোকান থেকে ফার্নিচার কিনে বসুন্ধরার বাসায় পৌঁছে দেন। নানা দিক থেকেই রাশেদ ওরফে র্যাশ এই হলি আর্টিজানের ঘটনার আগে তাঁর ভালো একটা সম্পৃক্ততা পেয়েছি আমরা।’
মনিরুল আরো বলেন, র্যাশকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বলা যায়, এই মামলার তদন্তকাজ প্রায় শেষপর্যায়ে পৌঁছে গেল। তাঁকে মূলত হলি আর্টিজানের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে। রিমান্ডে পেলে তাঁকে এই হলি আর্টিজান সম্পর্কে বা অন্যান্য যে সমস্ত ঘটনা সংগঠিত হয়েছে সেগুলো সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করা হবে।’
হলি আর্টিজানের হামলার পর কোথায় ছিলেন র্যাশ?
গত বছরের ১ জুলাই হলি আর্টিজানের হামলার পর জঙ্গিরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল কি না? আর হামলার এক বছর পর র্যাশ গ্রেপ্তার হলো-এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন? সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘১ জুলাইয়ের পর তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয় নাই, বিচ্ছিন্ন হয়েছে কল্যাণপুরের ঘটনার পর। ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের অভিযানের পর তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পরবর্তী কার্যক্রম চালায়। এ জন্য নারায়ণগঞ্জে তাঁরা দুটি বাসা ভাড়া নেন। একটি বাসা তাঁরা আগেই নিয়েছিলেন। আর একটি বাসা তামিম চৌধুরী গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন। ওই বাসাতে র্যাশের যাতায়াত ছিল। কিন্তু সেখানে তিনি থাকতেন না। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাশ স্বীকার করেছেন, তিনি মূলত উত্তরবঙ্গেই বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন। মাঝখানে তিনি গাজীপুরে ছিলেন। গাজীপুরে একই দিনে দুটি অভিযান পরিচালনার পর তিনি আবার উত্তরবঙ্গে চলে যান এবং সেদিকেই দীর্ঘদিন ছিলেন।’
পদ না পেয়ে অভিমান করে র্যাশ
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘র্যাশের আশা ছিল তাঁকে বড় একটা পদে দেবে, দেখা গেছে যে তামিম চৌধুরী মারা যাওয়ার পরে মইনুল ইসলাম মুসা আমির হয়ে যান বা প্রধান হয়ে যান। এর ফলে র্যাশের মধ্যে কিছুটা অভিমান কাজ করে। এরপর তাঁর যোগাযোগ হয় মারজানের ভগ্নিপতি সাগরের সঙ্গে। তিনি পুরোনো জেএমবির সঙ্গে ছিলেন। হলি আর্টিজানে হামলার আগে তাদের ভূমিকা যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘র্যাশ আগে জেএমবিতে ছিলেন এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি। এই নব্য জেএমবিতে তিনি খালেদের হাত ধরে যোগদান করেন। সাইফুল্লাহ ওজাফির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক পাইনি।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নব্য জেএমবির সদস্য সংখ্যা কত এটা সঠিকভাবে বলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তাঁরা ওইভাবে অফিশিয়ালি কমিটি গঠন করে না। তবে এতটুকু বলা যায় তাদের অপারেশনাল ক্যাপাসিটি যেটা, সেটা করার মতো সক্ষমতা অনেকটা কমে গিয়েছে। কিন্তু এটিও মনে রাখতে হবে, আমরা দেখছি সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে একজনই একটা হামলা চালাতে যথেষ্ট। আমরা মনে করি বাংলাদেশে এ রকম পরিস্থিতি নাই। এই মুহূর্তে বড় কোনো সহিংস ঘটনা ঘটানোর সক্ষমতা তাদের নাই।’