নেত্রকোনায় কিশোরীকে গণধর্ষণ, এবার আরএমওকে বদলি
নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মোস্তাফিজুর রহমানকে তাৎক্ষণিক বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজ) করা হয়েছে।
জেলার সিভিল সার্জন ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চিকিৎসক মোস্তাফিজুর রহমানের বদলির এই আদেশ পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) সমীর কান্তি সরকার স্বাক্ষরিত বদলিপত্রে ডা. মোস্তাফিজুর রহমানকে বরগুনা সদর হাসপাতালে আরএমও পদে যোগ দিতে বলা হয়েছে।
সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনায় কিশোরী পান্না আক্তারকে গণধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনায় প্রথম ময়নাতদন্তের জেরে এই বদলি কি না জানতে চাইলে সিভিল সার্জন বলেন, ‘এই মুহূর্তে তো বিষয়টি আলোচনাতে ছিলই।’
পান্নার পুনঃময়নাতদন্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অধিক সতর্কতার সহিত ময়মনসিংহে তা সম্পন্ন হবে।’
নেত্রকোনার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের নির্দেশে দাফনের নয়দিন পর আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ঠাকুরাকোনা কবরস্থান থেকে মরদেহ উত্তোলন করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সায়দা পারভীনের উপস্থিতিতে নেত্রকোনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে মরদেহ উত্তোলন করা হয়।
স্থানীয় কয়েকজন ও নিহত কিশোরীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোরী পান্না আক্তার ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ করে। পরিবারের সঙ্গে ঈদুল আজহা উদযাপন করতে গত ৩১ আগস্ট ঠাকুরাকোনা গ্রামের বাড়িতে যায় পান্না। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনসংলগ্ন একটি ঘরে মা-বাবার সঙ্গে থাকত সে। ঈদের পরের দিন ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গ্রামের যুবক মামুন কাজের কথা বলে পান্নাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যায়। রাত হয়ে গেলেও ফিরে না আসায় মা আল্পনা মেয়েকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। রাত ৮টার দিকে এলাকায় মাছের খামারের একটি ঘরে মামুন, কৌশিক সরকার অপুসহ তিন যুবকের কাছ থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় মেয়েকে উদ্ধার করেন তিনি। এ সময় তাঁর মেয়ে ধর্ষণের কথা জানিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলে যুবকরা ঘটনা প্রকাশ না করতে হুমকি দেয়। একপর্যায়ে প্রতিবেশীদের মধ্যে জানাজানি হলে পরের দিন সকালে ঘরের আড়ার সঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে পান্না।
খবর পেয়ে নেত্রকোনা মডেল থানার পুলিশ পান্নার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ৫ সেপ্টেম্বর পান্নাকে দাফন করা হয়।
পান্নার মা-বাবা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, প্রভাবশালী মহলের কাছ থেকে প্রভাবিত হয়ে নেত্রকোনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমির তৈমুর ইলি গণধর্ষণ ধামাচাপা দিতে শুধু অপমৃত্যুর মামলা করিয়ে নেন।
ওসি ময়নাতদন্তের আগেই সাংবাদিকদের জানান, পান্না রেপটেপ হয়নি। সে প্রেম সংক্রান্ত অভিমানে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। সুতরাং অপমৃত্যুর মামলা চলবে।
এদিকে দোষীদের আটক না করায় এবং পুলিশের ভূমিকায় ফুঁসে ওঠে নেত্রকোনার সর্বস্তরের মানুষ। তারা ধর্ষকদের গ্রেপ্তার এবং ওসিকে প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করে। এ আন্দোলনে সমাজের অন্তত ১৫টি বিভিন্ন সংগঠন অংশ নেয়। এসব আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সুপার (এসপি) জয়দেব চৌধুরীর নির্দেশে রহস্য উদঘাটনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন। তিনি কিশোরীর পরিবার ও এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন।
পরে পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার আটদিনের মধ্যে থানায় গণধর্ষণ ও আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করতে পারেন কিশোরীর মা আল্পনা। প্রত্যাহার করা হয় অপমৃত্যু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মোস্তাক আহমেদকে। আর গণধর্ষণ মামলার একদিন যেতে না যেতেই তিন আসামির দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন ঠাকুরাকোনা গ্রামের মামুন আকন্দ ও ছাত্রলীগ নেতা কৌশিক সরকার অপু। পরে গতকাল বুধবার বিকেলে তাঁরা ধর্ষণে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
পান্নার মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নেত্রকোনা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহিনূর এ আলম বলেন, ‘পান্না আক্তারের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের পর একটি অপমৃত্যুর মামলা করা হয়। এরপর তাকে গণধর্ষণের পর আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে দ্বিতীয়বার তিনজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসেনি। তাই মামলার সঠিক তদন্তের জন্য পুনরায় ময়নাতদন্তের করতে আমরা লাশ উত্তোলনের আবেদন করি। আদালতের আদেশে আজ কবর থেকে পান্নার লাশ উত্তোলন করা হয়েছে।’