‘ফাঁসানোর’ জন্য ‘সাজানো’ ছবি
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় দুই শিশুকে গাছের সঙ্গে বাঁধার ছবিটি ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ তোলা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন। তবে এ ঘটনায় স্থানীয় এক সাংবাদিকের ‘সম্পৃক্ততা’ পেয়েছে পুলিশ।
আজ শুক্রবার বিকেলে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর মোদাচ্ছের হোসেন শ্যামনগরের কাশিমারী ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের এক শিশুর বাড়ি থেকে যে রশি ও শেকল দিয়ে বেঁধে ছবিটি তোলা হয় সেগুলো উদ্ধার করেন। এ সময় তিনি শিশু দুটির সঙ্গে কথাও বলেন। শিশুরাই ‘ছবি তৈরির’ বিস্তারিত বর্ণনা পুলিশকে দেয়।
এ দিকে ছবির ‘কারসাজি’ উদঘাটনের পরপরই গা ঢাকা দিয়েছেন দুই শিশুর অভিভাবক। এ ছাড়া ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ ছবি বানিয়ে ‘ফাঁসানোর’ চেষ্টার অভিযোগে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।
গত ১৬ জুলাই পারিবারিক বিরোধপূর্ণ জমির খেজুর কাঁটার বেড়া সরিয়ে খেলা করার ‘অপরাধে’ উপজেলার জয়নগর গ্রামের গোলাম মোস্তফা একই পাড়ার দুই শিশু ইয়াসিন ও আবু নাসিমের হাতে রশি দিয়ে বেঁধে রাখেন। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে মোস্তফা ও তাঁর স্ত্রী মাসুদা খাতুনকে মারধর করেন ইয়াসিনের বাবা ইসমাইল হোসেন ও নাসিমের বাবা হামিদ তরফদার।
ঘটনার ছয়দিন পর ২২ জুলাই দুই শিশু ‘নির্যাতনের’ একটি ছবি স্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। পুলিশ গোলাম মোস্তফাকে আটক করে। ওই রাতেই শিশু আবু নাসিমের বাবা হামিদ তরফদার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শ্যামনগর থানায় মামলা করেন। পরদিন গোলাম মোস্তফাকে আদালত জেলহাজতে পাঠান। মামলায় আসামি করা হয় মোস্তফার ছেলে গোলাম হোসেনকেও।
পুলিশের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গোলাম মোস্তফা রাগে শিশু দুটির ‘পিঠে থাপ্পড় মেরে ক্ষণিকের জন্য হাত বেঁধে’ রাখার কথা স্বীকার করলেও দড়ি-শিকল দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেন। সিলেটের শিশু রাজন হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার মধ্যে এ ঘটনায় পুলিশ শুরু থেকেই ছিল তৎপর। যদিও এ ছবিটি নিয়ে সন্দেহ ছিল শুরু থেকেই।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ ছবিটির রহস্য উদঘাটনে তদন্ত শুরু করে। আজ শুক্রবার বিকেলে ঘটনাস্থলে গিয়ে শিশু দুটির সঙ্গে কথা বলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর মোদাচ্ছের হোসেন। ফিরে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুই শিশু জানায়, ঘটনার দিন মোস্তফা তাদের পিঠে দু-তিনটি চড় মারেন। এরপর কিছুক্ষণের জন্য হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে পরে খুলে দেন। এর দু-তিনদিন পর ইয়াসিনের চাচা ইলিয়াস তরফদার রশি ও শেকল নিয়ে তাদের বাড়িতে আসে। এর পরপরই সেখানে উপস্থিত হয় একজন সাংবাদিক।’
‘শিশুদের বলা হয়, তাদের বাড়ির গাছের সাথে সোজা হয়ে দাঁড়াতে। এ সময় ইলিয়াস ও ওই সাংবাদিক তাদের রশি ও শেকল দিয়ে বেঁধে দেন। এর পরপরই ওই সাংবাদিক তাদের ছবি তোলেন। শিশু দুটি ওই সাংবাদিকের নাম না জানলেও মুখ দেখলে তাঁকে চিনতে পারবে বলে জানিয়েছে।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরো বলেন, ‘শিশুরা জানিয়েছে, ওই সাংবাদিক ও ইলিয়াস কীভাবে গাছের গায়ে দাঁড়াতে হবে এবং পরে কেউ জিজ্ঞাসা করলে কী কী বলতে হবে তাও শিখিয়ে দেওয়া হয় তাদের।’
এদিকে শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ইয়াসিনের মা তাসলিমা খাতুন তাঁদের ঘর থেকে ছবি তোলার কাজে ব্যবহৃত রশি ও শেকল বের করে দেন। এ সময় স্থানীয় লোকজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল জয়নগর গ্রাম ঘুরে এসে শ্যামনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সাইয়েদ মঞ্জুর আলম রাতে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কথিত নির্যাতনকারী গোলাম মোস্তফার বাড়ি থেকে ছবি নেওয়া হলে তাঁর সঙ্গে বাড়িঘরের ছবি আসত। যে গাছের সঙ্গে শিশু দুটিকে বেঁধে রাখা অবস্থায় দেখানো হয়েছে সেই গাছটি শিশু ইয়াসিনের বাড়ির একটি গাছ। ছবিটি সাজানো। এর সঙ্গে শিশু নির্যাতনের বাস্তবতার কোনো মিল নেই।’
কালীগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মীর মনিরুজ্জামান জানান, বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে ছবির গাছটি চিহ্নিত করে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, শিশু নির্যাতনের সঙ্গে গাছের সঙ্গে বাঁধার কোনো সম্পর্ক নেই।
মামলার পরিবর্তে আপসরফার প্রস্তাব
এদিকে কারাগারে আটক গোলাম মোস্তফার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মাসুদা খাতুন এ ঘটনায় ‘উদ্দেশ্যমূলক ও পরিকল্পিতভাবে’ হয়রানির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে এলাকার কেউ কেউ তাঁকে আপসের প্রস্তাব দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
মাসুদা খাতুন এনটিভি অনলাইনকে গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘এলাকার চেয়ারম্যান গাজী আনিসুর রহমান আমাকে আপসরফা করে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অন্যথায় আমার স্বামীর জামিন হবে না। তখন আমি বলেছি, আমার দেওয়া মামলা রেকর্ড হওয়ার পর স্বামীর জামিন হলে আপসরফার ব্যাপারে ভাবা যাবে।’
মামলা করার কথা জানাজানি হওয়ার পর শিশু ইয়াসিনের চাচা ইলিয়াস তরফদার শ্যামনগর সদরে যেতে বাধার সৃষ্টি করেছেন বলেও অভিযোগ করেন মাসুদা।
তবে এ ব্যাপারে কাশিমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গাজী আনিসুর রহমান শুক্রবার রাতে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি মাসুদাকে বলেছি, ছোট্ট একটি ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে। তোমার স্বামীরও দোষ আছে। আমার মনে হয়, তাঁর জামিনের জন্য তোমারও একটু ছাড় দেওয়া প্রয়োজন।’