টাইম সাংবাদিকের চোখে রাখাইন পরিস্থিতি
যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ফেলিজ সলোমন। প্রায় ছয় বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন মার্কিন বংশোদ্ভূত এই সংবাদকর্মী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা ফেলিজ ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ছিলেন মিয়ানমারে। খুব কাছ থেকে দেখেছেন রোহিঙ্গাদের জীবনযাপন। সেই অভিজ্ঞতার কথা এনটিভির কাছে বলেছেন তিনি।
ফেলিজ সলোমন রোহিঙ্গা সংকটে গত এক সপ্তাহ ধরে ছুটে বেড়াচ্ছেন কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায়। রোহিঙ্গারা এখানে এসে তাদের প্রতি সামাজিক বৈষ্যমের কথা তুলে ধরছেন, সাংবাদিকতার চোখে নিজেও এমনটা দেখে এসেছেন তিনি।
টাইম ম্যাগাজিনের এই সাংবাদিকের ভাষ্য, রাখাইনে চরম সামাজিক বৈষ্যমের শিকার ছিল রোহিঙ্গারা। সেখানেও ক্যাম্পের মতোই জীবনযাপন করতে হয়েছে রাষ্ট্রপরিচয় বিহীন রোহিঙ্গাদের, এমন কী শহরেও থাকতে হতো ক্যাম্পের মধ্যে। সেই কঠিন জীবনে শিক্ষাদীক্ষা থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই বঞ্চিত করা হয় রোহিঙ্গাদের।
ফেলিজ সলোমন বলেন, ‘মিয়ানমারে আমি ২০১২ সালের সহিংসতার পর গিয়েছিলাম। সেখানে থাকা অবস্থায় দুবার রাখাইনেও গিয়েছি। আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি রোহিঙ্গাদের দেখে, তারা রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক বৈষম্যের শিকার। শহরেও রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের মধ্যে থাকে এবং গ্রামেও তাই। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গেলে পুলিশ চেকপোস্টে নাম স্বাক্ষর করে যেতে হয়। অনেক সময় মারধরের ঘটনাও ঘটে। রোহিঙ্গারা তাদের নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সবকিছুই নিজেদের গ্রাম বা ক্যাম্পের মধ্যে থেকে কিনতে বাধ্য। কারণ, বৌদ্ধরা তাদের কাছে কোনো কিছু বিক্রিও করে না। সত্যি অনেক কঠিন জীবন রোহিঙ্গাদের। অবিশ্বাস্য।’
শুধু তাই নয়, ছোট পরিবার-সুখী পরিবার এমন শিক্ষাটি পর্যন্তও রোহিঙ্গাদের দেওয়া হয়নি। এমন অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ফেলিজ জানান, এক পরিবারে অন্তত ২০টি সন্তানও রয়েছে। আর তাদের সব সুবিধা থেকেই বঞ্চিত করেছে মিয়ানমার সরকার।
ফেলিজ সলোমন বলেন, ‘বলতে গেলে রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গাদের কোনো সেবাই দেওয়া হয় না। শিক্ষা-দিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধা দেওয়া হয় না, এমনকি জন্ম নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত উপকরণ সরবরাহ করা হয় না। কাজেই পরিবার পরিকল্পনা না থাকার জন্য রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না।’
২০১২ সালে থাইল্যান্ডে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংবাদ সংগ্রহ করা ফেলিজ জানালেন তাঁর এবারের অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, ‘হৃদয় বিদারক, খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে দীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে বাংলাদেশে আসছে। তাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাঁরা যেটি জানিয়েছে যে তাদের ঘরে এখন কোনো খাবার নেই। খাবারের জন্য এখন তাঁরা কোথাও যেতেও পারে না। মগরা তাদের সব কিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আর এখানে পালিয়ে আসা বিপুল রোহিঙ্গার বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্যানিটেশন ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা। তবে বাংলাদেশের মানুষজন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা বলেছে, আমরাও একসময় শরণার্থী হয়ে পাশের দেশে গিয়েছিলাম। কাজেই শরণার্থীদের দুঃখ-কষ্ট আমরা বুঝি।’
টাইম ম্যাগাজিনের এই সংবাদকর্মীর মতে, যুগ যুগ ধরেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হয়ে আসছিল, যার চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ ঘটেছে ২০১৭ সালে। আর তাদের এই মানবিক বিপর্যয়ে যেভাবে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ তা প্রশংসার দাবি রাখে।