জনগণের জীবনমান নিম্নমুখী হয়েছে: ফখরুল

Looks like you've blocked notifications!
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। ছবি : ফোকাস বাংলা

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ তে জনগণের জীবনমান নিম্নমুখী হয়েছে। ২০০৫ সালে ক্যালরি অর্থাৎ পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৩৯, ২০১০ সালে ২ হাজার ৩১৮ এবং ২০১৬ সালে ২ হাজার ২১০। ক্যালরি গ্রহণের দিক থেকেও ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে নিম্নমুখী হয়েছে।

২০১০ সালের তুলনায় গৃহস্থালীর প্রকৃত আয় ২০১৬ সালে ১১ শতাংশ কমে গেছে। ২০১০ সালের তুলনায় ব্যক্তি প্রতি মাথাপিছু প্রকৃত আয় ২০১৬ সালে ২ শতাংশ কমেছে এবং প্রকৃত ভোগব্যয় কমেছে ১ শতাংশ। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জীবন মানের অবনতি ঘটেছে।

আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য সরকারের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশ ছিল, ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩ শতাংশের বেশি হবে না। এমনকি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করে। অথচ সরকার এ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘প্রায় প্রতি বছরই প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত সরকারি প্রাক্কলনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো দ্বিমত পোষণ করে আসছে, পরিসংখ্যানের তেলেসমাতি করে সরকার বরাবরই জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীও তাই করলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি শ্লথ হয়ে গিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বার্ষিক হার ৩ দশমিক ১ শতাংশ হলেও ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসে। যা অর্থনীতিতে সুযোগের সমতা নিশ্চিতকরণ ও সুবিধাবঞ্চিতদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্রবৃদ্ধির ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন হ্রাস, প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ার প্রবণতা ও কর্মসংস্থানের অভাব একদিকে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মানের উপর প্রতিকূল প্রভাব সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করছে। এরই মধ্যে দেশে ২০১০ সালের দুই হাজার ৩১৮ কিলোক্যালরি থেকে ২০১৬ সালে গড় মাথাপিছু দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ পাঁচ শতাংশ কমে দুই হাজার ২১০ কিলোক্যালরিতে নেমে আসে।’

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আয়-বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে আর এটাকেই সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় বলে মনে করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি আয়-বৈষম্য হ্রাস না পেলে সাধারণ জনগণ উন্নয়নের সুফল পায় না, দারিদ্র্য হ্রাস পায় না, বেকারত্ব পরিস্থিতির উন্নতি হয় না।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের ফলাফল জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, বৈষম্য বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদরা ‘গিনি সূচক’ ব্যবহার করেন। ২০১০ সালে সবচাইতে দরিদ্র এক পঞ্চমাংশ (১/৫) গৃহস্থালী মোট আয়ের ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ পেয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে গরিবের হিস্যা হ্রাস পেয়ে ১ দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়ায়। অন্যদিকে আয়ের সর্বোচ্চ স্তরে ৫ শতাংশ গৃহস্থালীর ২০১০ সালে আয়ের হিস্যা ছিল ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে ধনীদের হিস্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৯ শতাংশে। এই সময়ে গরীব ও ধনীর মধ্যে আয়ের বৈষম্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ ২০০৫ সালে গিনি সূচক ছিল ০.৪৬৭ এবং ২০১০ সালে ছিল ০.৪৫৮। অর্থাৎ ওই সময়ে আয় বৈষম্য খানিকটা  হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে গিনি সূচক ০.৪৮৩ দাঁড়িয়েছে। এর অর্থ হলো আয়-বন্টনে এই সময়ে বৈষম্য অনেক তীব্রতর হয়েছে।’

অর্থনীতিবিদরা ‘গিনি সূচক’ ০.৫ কে অত্যন্ত বিপদজনক মনে করেন উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাংলাদেশ ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে সেই বিপদজনক অবস্থার খুব কাছাকাছি চলে গেছে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্য বৃদ্ধি কোনোক্রমেই জনকল্যাণের ইঙ্গিত দেয় না। অর্থনীতির এই চেহারার জন্য দায়ী হলো শেয়ারবাজার কেলেংকারি, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ভয়াবহ লুণ্ঠন, মূল্যস্ফীতি, মেগা-প্রকল্পকেন্দ্রিক ডাকাতি, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা ও সর্বস্তরে লাগামহীন ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি।’

এ সময় সরকারের বিভিন্ন উন্নয় প্রকল্পের সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেই সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার বেইল আউট প্রোগ্রামের আশ্রয় নিয়েছে। বেইল আউট প্রোগ্রামের ফলে বাড়তি করের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকিং সেক্টরের লুটপাট থেকে লাভবান হচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি।’

দেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের চার সদস্যের নিয়োগ, চালের দাম বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ করে সরকারের সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল। সংবাদ সম্মেরনে টিসিবির তথ্য অনুযায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। মির্জা ফখরুল বলেন, দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি কৃষি, শিল্পসহ অর্থনীতির সব খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এর ফলে পাঁচ লাখ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে গেছে বলে একটি সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অথচ সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ২০২১ সালের মধ্যে শতকরা ১৩ ভাগে নিয়ে আসা।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরের গড়ে বিদেশে টাকা পাচার হয় ৮১ হাজার কোটি টাকা। শুধু ২০১৫ সালেই বিদেশে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা যা খুবই উদ্বেগজনক। ২০১১ সালে সুইস ব্যাংকে  বাংলাদেশিরা ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা জমা করে ; আর ২০১৫ সালে জমা করে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। মাত্র চার বছরে জমাকৃত টাকার পরিমাণ চার গুণ বেড়ে যায়।’

দেশের ভেতর বিভিন্নভাবে লুটপাট করে অবৈধভাবে অর্জিত এসব টাকা বিদেশে পাচার করার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অধিকাংশই আওয়ামী ঘরানার লোক বা আওয়ামী সরকারের মদদপুষ্ট হওয়ায় এই পাচার রোধে সরকারের দৃশ্যত কোনো ভূমিকা নেই বলেও অভিযোগ করেন বিএনপির মহাসচিব।