প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ভয়ঙ্কর নাটক!
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার তরুণ জলালকে (২০) হত্যার অভিযোগে ২০১০ সালের ১১ মে থানায় মামলা করেছিলেন বড় ভাই মকজ্জিল আলী (৩৫)। রহস্য উদঘাটনে একের পর পর চারজন তদন্ত কর্মকর্তা মাঠে নামেন। কিন্তু কোনো সূত্র পাননি তাঁরা। আদালতে দেন চূড়ান্ত প্রতিবেদন। চারবারই ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে না-রাজি আবেদন করে পুনরায় তদন্তের আবেদন জানান বাদী।
সর্বশেষ তদন্তে নেমে জলাল হত্যার রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তারা জানিয়েছে, সংঘবদ্ধ গাছ চোরচক্রকে আড়াল করতেই সাজানো হয় এই হত্যার নাটক। নিহত জলালের আপন দুই ভাই মকজ্জিল (মামলার বাদী) ও মকদ্দিছ প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য এই হত্যা মামলার পরিকল্পনা করেন। তাঁদের ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে স্থানীয় কয়েকজনকে জেলও খাটান।
জলাল হত্যা মামলা নিয়ে আজ রোববার দুপুরে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি জানান, জেলার কুলাউড়া উপজেলার কেওলাকান্দি বিলের পাড় এলাকার আরজু মিয়ার ছেলে মকজ্জিল আলী (৩৫) ২০১০ সালের ১১ মে কুলাউড়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় উল্লেখ করেন, ১০ মে রাত থেকে তাঁর ছোট ভাই ভিকটিম জলাল বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজ করার একপর্যায়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তাঁর আরেক ভাই ময়না মিয়া গরু চড়াতে গিয়ে তাঁদের বাড়ির পশ্চিম পাশের টিলার ঢালুতে জলালের মরদেহ লাশ দেখতে পান। ওই ঘটনায় নিহত জলালের বন্ধু জাবের (২২), পংখী (২৩), মীর (৩৫), শাহিদ (৫৫), রেমান (৬০), মসুদসহ (৪৫) সন্দেহভাজনদের আসামি করেন মকজ্জিল আলী।
বাদী মামলায় উল্লেখ করেন, তাঁর মামাতো বোন রোকেয়ার বাড়িতে ভিকটিম জলালসহ অন্য আসামিদের যাতায়াত নিয়ে কোন্দল থাকায় পূর্বশত্রুতার জের ধরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
পিবিআই কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন জানান, মামলার প্রথম তদন্তভার পড়ে কুলাউড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শফিকুল ইসলামের ওপর। তিনি মামলাটি ১৪ মাস তদন্ত করে কোনো সূত্র উদঘাটন করতে না পেরে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। এরপর বাদীর না-রাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে একে একে কুলাউড়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুর রহমান, ওসি মো. সেলিম নেওয়াজ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায়।
সিআইডির চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধেও বাদী না-রাজি আবেদন করলে আদালত মামলাটির তদন্তভার পিবিআই মৌলভীবাজারের ওপর ন্যস্ত করেন। পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে তদন্তের একপর্যায়ে জানতে পারেন বাদী মকজ্জিল আলীসহ একটি গাছ চোরচক্র এই ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে এই পরিকল্পনা করেন।
পিবিআইয়ের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ৩১ জানুয়ারি ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কুলাউড়া থানার কেওলাকান্দি বিলের পাড়ের আরজু মিয়ার ছেলে আজাদ মিয়া, ইদরিছ কোম্পানির ছেলে আহাদ মিয়া, মৃত আবদুর রহমানের ছেলে ছৈয়ব আলীকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। আটককৃতদের তথ্যের ভিত্তিতে এই মামলার বাদী মো. মকজ্জিল আলীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যার ঘটনাস্থল চিহ্নিত করাসহ ঘটনায় ব্যবহৃত ঠেলাগাড়ি ও গাছ কাটার করাতও উদ্ধার করা হয়। মামলার বাদী মকজ্জিল আলীসহ গ্রেপ্তার হওয়া আজাদ, আহাদ ও ছৈয়ব আলী এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
কী ঘটেছিল ১০ মে
পিবিআই কর্মকর্তা তদন্ত করে জানতে পেরেছেন, ২০১০ সালের ১০ মে রাত ১২টার দিকে রোশন ও আজাদের দুটি ঠেলাগাড়িসহ আজাদ, ছৈয়ব আলী, ভিকটিম জলাল, মকদ্দিছ, রোশন ও মকজ্জিল চাতলাপুর বাগানের ১০ নম্বর সেকশনে যান। সেখানে যাওয়ার পর হরিধন ও মাখন চৌকিদারের সহায়তায় তাঁরা একটি কড়ই গাছ কাটেন এবং গাছটিকে কয়েক টুকরো করেন। গাছের টুকরোগুলো আজাদ ও রোশনের ঠেলাগাড়িতে উঠান। আজাদের ঠেলাগাড়িতে হাত লাগান ছৈয়ব আলী, আজাদ, আহাদ ও নিহত জলাল। রোশনের ঠেলাগাড়িতে হাত লাগান মকদ্দিছ, রোশন ও বাদী মকজ্জিল আলী। দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ঠেলাগাড়ি চালিয়ে চাতলাপুর রাবার বাগানের কাঁচা রাস্তায় মোকামের আম গাছের ঢালুতে এলে আজাদের ঠেলাগাড়ির অ্যাক্সেল ভেঙে কাটা গাছের অংশ জলালের ওপর পড়ে। তখন সবাই জলালের ওপর থেকে গাছের অংশ সরান। এতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত পান জলাল। এই ঘটনার পর প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে মকজ্জিল আলী ও মকদ্দিছ তাঁদের ছোট ভাই জলালকে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। বাড়িতে আসার পরই জলাল মারা যান। এই ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ও ভিন্ন খাতে নিতে মকজ্জিল আলী ও তাঁর ভাই মকদ্দিছ ছোট ভাই জলালের লাশ তাঁদের বাড়ির পেছনের টিলার ঢালুতে রাখেন।
এ ছাড়া জলাল গুরুতর আহত হওয়ার পরও চোরাই করা গাছের লোভ সামলাতে না পেরে তাঁকে হাসপাতালে না নিয়ে আসামি আজাদ, ছৈয়ব আলী, রোশন ও আহাদ মিলে রোশনের ঠেলাগাড়ি দিয়ে কাটা গাছের অংশ কছমলি পার এলাকার খালিকের বাড়িতে এবং অন্যগুলো হাজিপুর স’ মিলে নিয়ে যান। পরদিন লাশের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্তলে সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়।
জেলের ভাত খান সাত ‘নিরীহ’, সংসার ভাঙে দুটি
মকজ্জিল আলীর করা মামলায় পুলিশ পংখী, জাবের, মীর, জলিল, রেমান, শাহিদ ও মসুদ মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছিল। তারা দীর্ঘদিন কারাভোগ করে বর্তমানে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন।
এই ঘটনার পর থেকে রোকেয়ার প্রবাসী স্বামী দেশে এসে তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করে অন্যত্র বিয়ে করেন। রোকেয়ার বাড়ি সংলগ্ন আকমল আলীকে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে মকজ্জিল তাঁকে প্রত্যক্ষ সাক্ষী সাজিয়ে আদালতে একটি অ্যাফিডেভিট দায়ের করেন। একইভাবে আকমল আলীর স্ত্রী শাহানাকেও প্রত্যক্ষ সাক্ষী বানানোর চেষ্টা করেন মকজ্জিল। শাহানা রাজি না হলে এই নিয়ে আকমলের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। একপর্যায়ে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার জেলা পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন, পরিদর্শক গোলাম কিবরিয়া, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. তরিকুল ইসলামসহ পিবিআইয়ের অন্য সদস্যরা।