যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ হচ্ছে খুলনা শিপইয়ার্ডে

Looks like you've blocked notifications!

লোকসানের কারণে খুলনা শিপইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ সময় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর পর ১৫ বছরের ব্যবধানে সেই রুগণ প্রতিষ্ঠানটি আজ লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌযানের চাহিদা পূরণ করে সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ করে আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম অর্জন সম্ভব হয়েছে। এবারই খুলনা শিপইয়ার্ডে প্রথমবারের মতো বড় দুটি যুদ্ধজাহাজের নির্মাণকাজ হতে যাচ্ছে। আজ রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনা শিপইয়ার্ডে এই নির্মাণকাজের উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন।

১৯৫৪ সালের শেষ দিকে রূপসা শিল্প এলাকায় রূপসা নদীর তীরে ৬৮ দশমিক ৯৭ একর জমির ওপর খুলনা শিপইয়ার্ড যাত্রা শুরু করে। শিপইয়ার্ড নির্মাণে প্রথম পুঁজি বিনিয়োগ ছিল দুই কোটি ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা। পরে যন্ত্রাংশ দিয়ে মোট প্রকল্প ব্যয় হয়েছিল চার কোটি ১৫ লাখ টাকা।

ভূমি জরিপসহ শিপইয়ার্ড স্থাপনের দায়িত্বে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োজিত ছিল জার্মানির হামবুর্গের মেসার্স স্টুলকেন শেন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। শিপইয়ার্ড স্থাপন করতে প্রায় তিন বছর সময় লেগে যায়। ১৯৫৭ সালের ২৩ নভেম্বর এর আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। মেসার্স স্টুলকেন শেনের চুক্তির মেয়াদ ১৯৫৭ সালেই শেষ হয়ে গেলে ব্রিটিশ কনসালট্যান্সি ফার্ম মেসার্স বার্নেস কলেট অ্যান্ড পার্টনার্স খুলনা শিপইয়ার্ড পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তাদের মেয়াদ ১৯৬৪ সালে শেষ হয়ে গেলে জেনেভার কনসালট্যান্সি ফার্ম মেসার্স মাইয়ারফর্মের কাছে এ দায়িত্ব যায়। এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব মেয়াদ ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে শেষ হয়ে গেলে শিপইয়ার্ড পরিচালনার জন্য আর কোনো বিদেশি ফার্মকে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে দেশীয় লোকবলের মাধ্যমে খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড পরিচালিত হয়ে আসছে।

খুলনা শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠার প্রথম পাঁচ বছরে ৪৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা লোকসান করার পর ১৯৬২-৬৩ অর্থবছর থেকে ১৯৭০-৭১ সাল পর্যন্ত মুনাফা অর্জন করে। পরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে আবারো কোটি টাকা লোকসান করে। তার পর ১৯৮২-৮৩ অর্থবছর পর্যন্ত ছয় কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করে। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছর থেকে ১৯৯১-৯২ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১৭ কোটি টাকা আর্থিক সংকটে পড়ে, রুগণ শিল্পে পরিণত হয়।

আর্থিক সংকট ও কর্তৃপক্ষের অবহেলায় প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হলে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। নানা সংকটে খুলনা শিপইয়ার্ড ৯৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকার ঋণে জড়িয়ে যায়।

১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনা শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন। তার পর শুধু ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। সব দায়দেনা পরিশোধ করে ২০১০-১১ অর্থবছরে মুনাফা করে ২৫ দশমিক ৭০ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২৫ দশমিক ৯০ কোটি, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪১ দশমিক ৭২ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৭ দশমিক ৫৯ কোটি ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট মুনাফা করেছে ৫৮ দশমিক ৮০ কোটি টাকা। গত পাঁচ বছর খুলনা অঞ্চলের সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গত ১৫ বছরে বার্ষিক টার্নওভার ১৭ দশমিক ৪৪ গুণ বেড়েছে, ১৬ কোটি থেকে হয়েছে ২৭৯ কোটি টাকা।

খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর এস ইরশাদ আহমেদ বলেন, ‘শুধু সঠিক নেতৃত্বদানই খুলনা শিপইয়ার্ডকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।’ তিনি জানান, নৌবাহিনীর প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল এম ফরিদ হাবিব পদাধিকারবলে খুলনা শিপইয়ার্ডের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান। রিয়ার অ্যাডমিরাল আর ইউ আহমেদ ভাইস চেয়ারম্যান। আর পরিচালকরা হলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল সাইফুল কবির, রিয়ার অ্যাডমিরাল এএমএমএমএ চৌধুরী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খালেদা পারভিন, নৌ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মো. সাদেকুল বারী, এমডি কমডোর এস ইরশাদ আহমেদ, পরিচালক সি এম শাহীন ইকবাল, কমডোর এম জাহাঙ্গীর আলম, আইসিএমএবির প্রেসিডেন্ট মো. সেলিম, ক্যাপ্টেন এম এস করিম ও ক্যাপ্টেন এম আবদুল আলিম।

খুলনা শিপইয়ার্ডের এমডি বলেন, এ মুহূর্তে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে এক হাজার ২০০ লোক কাজ করছে এখানে। কাজের চাপে দিনে দুই শিফট ছাড়াও রাতেও কাজ চলে। এ ছাড়া ২০ জন নাবিক এখানে কর্মরত। বাকি আর সবই আগেকার লোকবল বহাল রয়েছে। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার জন্য সাপ্তাহিক নিয়মিত মিটিং হয়। তাঁরা নিয়মিত বোনাসও পান।

খুলনা শিপইয়ার্ডের জিএম (উৎপাদন) ক্যাপ্টেন এম জাকিরুল ইসলাম বলেন, এখানে সবাই সবার দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। শ্রমিক ইউনিয়ন না থাকলেও শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে নিয়মিত দরবার সভা হয়। সবার মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।

৩৭ বছর ধরে খুলনা শিপইয়ার্ডে কর্মরত প্রবীণ কর্মী সুপারভাইজার ফরিদ আলী বলেন, নৌবাহিনীর কাছে দায়িত্ব পাওয়ার আগে তাদের কাজ ছিল না, অলস সময় কাটাতে হতো। কিন্তু এখন এত কাজ যে তাদের নিয়মিত অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। 

এবার খুলনা শিপইয়ার্ডে নির্মিত হচ্ছে নৌবাহিনীর জন্য বড় ধরনের যুদ্ধজাহাজ। এর দৈর্ঘ্য ৬৪ দশমিক ২০ মিটার। ৭০ জন নাবিক নিয়ে চলাচল করতে সক্ষম এই যুদ্ধজাহাজ ২৫ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলবে। ৬৭৪ টন ওজনের এই যুদ্ধজাহাজে রাডারসহ বিভিন্ন ভারী অস্ত্র থাকবে। এই যুদ্ধজাহাজ দেশে নির্মাণের ফলে ৩৬-৩৮% বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। প্রতিরক্ষা খাতে থাকায় এর মোট ব্যয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন খুলনা শিপইয়ার্ডের এমডি।