মীরকাদিমের ধবল গরুর ঐতিহ্য প্রায় বিলীন

Looks like you've blocked notifications!
দিন দিনই বিলীন হয়ে যাচ্ছে মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমের ধবল গরুর ঐতিহ্য। ছবি : এনটিভি

কোরবানিতে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে ছিল মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমের ধবল (সাদা) গরু। স্বাদে অতুলনীয় এ মাংসের খ্যাতি বুড়িগঙ্গার তীর, পুরান ঢাকাজুড়েই। কোরবানির ঈদে পুরান ঢাকাবাসীর রসনা বিলাসে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক, মীরকাদিমের সাদা গরুর মাংস থাকা চাই। কিন্তু নানা কারণে এসব গরুর অর্ধশত বছরের ইতিহাস ও খ্যাতি আজ বিলুপ্তির পথে।

কোরবানির ঈদ উপলক্ষে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য ঢাকার রহমতগঞ্জ মাঠে (পুরোনো নাম গণিমিয়ার হাট) মীরকাদিমের সাদা গরুর হাট বসে। আগে পাঁচ দিনে অন্তত তিন হাজার সাদা গরু বিক্রি হতো। কিন্তু এখন এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ একশ’ গরু মীরকাদিম থেকে ঢাকার রহমতগঞ্জ মাঠে যায়। 

ভারতের উড়িষ্যার জঙ্গলি, নেপালের নেপালি, ভুটানের বুট্টি গরু কিনে মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমে লালনপালন করে কোরবানি ঈদে বিক্রি করার জন্য। আর এসব গরুকে খাওয়ানো হয় একেবারেই প্রাকৃতিক জিনিস। এসব গরুর খাদ্য হিসেবে মিনিকেট চালের খুদ, এক নম্বর খৈল, ভাতের মার, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভুসি, গমের ভুসি, বুটের ভুসি দেওয়া হয়। গরু মোটাতাজা করতে এ গরুকে কোনো ওষুধ প্রয়োগ করতে হয় না।
মীরকাদিমের গরুর লালনপালনের খরচ যেমন বেশি, তেমনি এ গরুর মাংস খেতে সুস্বাদু হওয়ায় কদরও বেশি। তাই এ গরু কিনতে হলে ক্রেতাকে একটু বেশি টাকা নিয়েই হাটে আসতে হয়। এসব গরুর মূল্য ৮০ হাজার থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে মীরকাদিমের গরু মুন্সীগঞ্জের কোনো হাটে বিক্রি হয় না। সব গরুই চলে যায় পুরান ঢাকার হাটে। তবে গত কয়েক বছরের লোকসানে এ গরু আমদানি ও লালনপালন বন্ধ করে দিয়েছেন খামারিরা। 

গরুর খামার মালিক বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘মীরকাদিমে গরু বানানো (পালন) এখন প্রায় বন্ধ। সামনের বছর নাও পেতে পারেন। আগের বছর ৫০টা গরু বানাইছিলাম, এইবার ২২টা। সাদা বুট্টি গরু এখন পাওয়া যায় না, বানামু কেমনে? আগের বছর লোকসান খাইছি। শখে আর আনন্দে গরু পালি। মীরকাদিমের গরুর একটা ঐতিহ্য ছিল। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা আজ পঙ্গু হইয়া যাইতাছি।’ তিনি বলেন, ‘গরু বেইচা ঢাকার থিকা কিরা কসম কাইটা আসি আর গরু পালুম না। দুই তিন মাস পরে মন মানাইতে পারি না। আবার গরু পালি। ঢাকার হাটে এক ঘণ্টার বেচাকেনা। আমরা গরু নামাই, যার ভাগ্য ভালো দামও ভালো পায়, আর এক ঘণ্টার মধ্যেই সব গরু বিক্রি হয়ে যায়।’

খামার মালিক লতিফ মেম্বার বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ থেকে গরু এনে লালনপালন করি। ছোট বুট্টি গরু ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা কিনে আনি, চার-পাঁচ মাস লালন করে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিক্রি করি। এই গরু বেশি বড় হয় না। দেখতে গোলগাল। আর নেপালি ও ভারতের অন্য প্রজাতির বড় গরু কিনি প্রায় লাখ টাকা দিয়ে। ছয় মাস লালনপালনের পর এ গরু বিক্রি হয় দুই থেকে ছয় লাখ টাকায়। প্রতিটি গরুতে ৫০ হাজার টাকা খাওয়ার খরচ আছে।’

খামার শ্রমিক জিন্নাহ বলেন, ‘মীরকাদিমের ধবল গরু বানাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। ভারত ও ভুটানের আবাল-পশ্চিমা সাদা ষাঁড় ও সাদা গাভীর বাচ্চা কিনে আনেন মীরকাদিমের খামারিরা। নিজের বাচ্চার মতো লালনপালন করি। সময়মতো খাবার খাওয়াতে হয়। নতুন গামছা দিয়ে গোসল করাই। সব সময় চোখে চোখে রাখি। প্রতিটি গরু বড় করতে ও কোরবানির হাটে বিক্রি করার জন্য উপযোগী করে তুলতে চার থেকে ছয় মাস সময় লাগে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যত্ন, পরিচর্যা, স্বাস্থ্যসম্মত ভালো খাবার এখানে খাওয়ানো হয়। ইনজেকশন বা গরু মোটাতাজার কোনো ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। সাদা গরু এখন পাওয়া যায় না, তাই বিভিন্ন রঙের গরু বানানো হয়। খামারের ভেতরের পরিবেশ বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। বাইরের কাউকে খামারের ভেতর ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হয় না। চার-পাঁচ জন লোক হরহামেশা গরু যত্ন নেওয়ার জন্য নিয়োজিত থাকেন।’ 

মীরকাদিমের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জানান, আগের মতো ঘরে ঘরে মীরকাদিমে গরু কেউ বানায় না। রহমতগঞ্জের গণিমিয়ার হাট বলতে মীরকাদিমের গরুকে বোঝাত। এখন হাতেগোনা কয়েকজন গরু পালন করেন।