বিলুপ্ত রেংমিটচা ভাষার সন্ধান

Looks like you've blocked notifications!
চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি বান্দরবান প্রেসক্লাবে রেংমিটচা ভাষা জানা কয়েকজন ম্রোকে সঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড এ পিটারসন রেংমিটচা ভাষা পুনরুদ্ধারের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। ছবি : আলাউদ্দিন শাহরিয়ার

বান্দরবানের দুর্গম পার্বত্য এলাকায় ‘রেংমিটচা’ নামে অধুনা বিলুপ্ত একটি ভাষার খোঁজ মিলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক ভাষাবিজ্ঞানীর ১৬ বছরের গবেষণা ও অনুসন্ধানে রেংমিটচা ভাষায় কথা বলেন এমন ৩০ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। 

সম্প্রতি বান্দরবানে দীর্ঘ ১৬ বছর গবেষণা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমুথ কলেজের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসন অধুনা বিলুপ্ত ‘রেংমিটচা’ ভাষাটি পুনরুদ্ধার করার ঘোষণা দেন। এ গবেষণায় পিটারসনের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাইরা খান। 

বিলুপ্তপ্রায় এ ভাষা পুনরুদ্ধারকারী ডেভিড পিটারসন জানান, আলীকদম উপজেলার তৈনফা মৌজায় রেংমিটচা ভাষায় কথা বলেন এমন ৬৫ জনের তথ্য তিনি পেয়েছেন। তবে তাঁদের মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত ৩০ জনকে শনাক্ত করা গেছে। তাঁদের সবার বয়স পঞ্চাশের বেশি। তবে তাঁরা ভাষাটি জানলেও সাধারণত কথা বলেন ম্রো ভাষায়। তাঁদের সন্তানদের কেউ রেংমিটচা ভাষাটি না জানায় এঁদের মৃত্যুর পর ভাষাটি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা করেছেন গবেষকরা। 

যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও সংরক্ষণের অভাবে এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অনেক ভাষা এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে, আর কিছু ভাষা বিপন্ন অবস্থায় আছে। হারিয়ে যাওয়া ভাষাগুলোর মধ্যে রেংমিটচা ছিল অন্যতম। 

শত শত বছর আগে ম্রো সম্প্রদায় রেংমিটচা ভাষাতেই কথা বলত। যুগের পরিক্রমায় অন্য ভাষার প্রচলনে এই ভাষা বিলুপ্ত হতে থাকে। কিন্তু তৈনফা এলাকায় ম্রো জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ এখনো নিজেদের মধ্যে রেংমিটচা ভাষার প্রচলন রেখেছেন। তবে রেংমিটচা ভাষার মানুষের সংখ্যা কম। যে কারণে ম্রো ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকায় তাঁদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও এখন কেউ রেংমিটচা ভাষাটি জানে না। 

গবেষক ডেভিড এনটিভি অনলাইনকে জানান, ১৯৯৯ সালে তিনি প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন এবং এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ভাষা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এই গবেষণার অংশ হিসেবেই তিনি ১৯৬০ সালে জার্মান ভাষাবিজ্ঞানী লরেন্স জি লোফলার লেখা ‘ম্রো’ শিরোনামে একটি বই খুঁজে পান, যাতে হারিয়ে যাওয়া রেংমিটচা ভাষা সম্পর্কিত তথ্য ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ম্রো জনগোষ্ঠীকে নিয়ে সর্বপ্রথম বই প্রকাশ করেছিলেন এই লাফলারই। 

২০০২ সালের দিকে ডেভিড পাহাড়ি খুমি, খেয়াং, বম এবং ম্রো জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কাজ করার সময় তিনি ম্রোদের সঙ্গে মিশে যাওয়া বিলুপ্ত রেংমিটচাভাষীর একজনকে খুঁজে পান। এই ভাষাভাষীরা নিজেদের ম্রো হিসেবে পরিচয় দিলেও তাঁদের ভাষা ছিল ম্রোদের চেয়ে একেবারেই আলাদা । 

২০০৯ সালে ডেভিড বান্দরবানে বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধারকৃত ভাষা রেংমিটচা ভাষাভাষী মানুষ অনুসন্ধান এবং রেংমিটচা ভাষা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ ১৬ বছর পর তিনি রেংমিটচা ভাষাভাষী ১২ জনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রেকর্ড করতে সক্ষম হন। এর ফলে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি বান্দরবান প্রেসক্লাবে রেংমিটচা ভাষা জানা কয়েকজন ম্রোকে সঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড এ পিটারসন রেংমিটচা ভাষা পুনরুদ্ধারের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। 

ডেভিড জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ডকুমেন্টিং এন্ডেনজার্ড লেঙ্গুয়েজেস প্রোগ্রাম এরই মধ্যে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বান্দরবানে ম্রো জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধারকৃত রেংমিটচা ভাষা সংরক্ষণকে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পুনরাবিষ্কৃত এই ম্রো ভাষার বর্ণমালা তৈরি, ম্রো জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে এ ভাষার প্রচলনের ধারণাপত্র তৈরি ও সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহার উপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে আরও কয়েক বছর গবেষণা চলমান থাকবে বলে জানান তিনি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাইরা খান জানান, ষাটের দশকে রেংমিটচাভাষীদের প্রথম খুঁজে বের করেন জার্মান ভাষাবিদ লরেন্স জি লোফলার। তার পর এ ভাষা নিয়ে আর খুব একটা কাজ হয়নি। দেড় দশক ধরে মার্কিন গবেষক ডেভিড এ পিটারসন বান্দরবানের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কাজ করছেন। 

ম্রো জনগোষ্ঠীর ইতিহাস গবেষক সিইয়ং ম্রো বলেন, রেংমিটচা একটি আলাদা ভাষা। এই ভাষাভাষীরা আলাদা জনগোষ্ঠীর। সংখ্যায় কম হওয়ায় তাঁরা এখন ম্রো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। একসময় এই ভাষাভাষীরা নিজেদের রেংমিটচা হিসেবে পরিচয় দিত। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে তাঁরা নিজেদের ‘ম্রোখুমি’ পরিচয় দিয়ে থাকে। তিনি জানান, আরাকানে সম্ভবত এ ভাষার আরো লোকজন থাকতে পারে।