পাগল আইনে আটক রেখে সম্পত্তি আত্মসাৎ!

Looks like you've blocked notifications!
ফজলু। ফাইল ছবি

সিলেটের আদালত এলাকা থেকে ১৯৯৩ সালে পুলিশ ফজলুকে আটক করে সন্দেহভাজন হিসেবে। কিন্তু এর পর আদালতের চোখে কোনো অপরাধ না করেও আইনের মারপ্যাঁচে কারাগারে কেটে যায় তাঁর ২২টি বছর। তাঁর নামে পাগল আইনে করা হয় মামলা।

আইনজ্ঞরা বলছেন, পাগল আইনে মামলা হলে সহজে বের হওয়া যায় না। আর এ কারণেই এই কুটিল পথ অনুসরণ করেছে চক্রান্তকারীরা।

ওই বছর ১১ জুলাই কোতোয়ালি থানা এলাকার ট্রাফিক সার্জেন্ট জাকির হোসেন ফজলুকে আটক করে নিজে বাদী হয়ে পাগল আইনে মামলা করেন। মামলায় প্রথমে ফজলুর বাবা এবং গ্রামের নাম অজ্ঞাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরে ‘অজ্ঞাত’ শব্দটি কেটে বাবার নাম সৈয়দ গোলাম মাওলা ও গ্রামের নাম ধরাধরপুর লেখা হয়।

এত বছরে কেউই জানত না ফজলু বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। তাঁর সহপাঠী কামাল উদ্দীন রাসেল বলেন, ‘এরে আমি খুঁজতেছি আজ ১৫ বছর যাবৎ। আমি জানি যে, সে মারা গেছে।’

দক্ষিণ সুরমা এলাকার ধরাধরপুর সৈয়দ বাড়ির নিঃসন্তান দম্পতি গোলাম মাওলা ও নয়ন মণি ফজলুকে পালক ছেলে হিসেবে লালন-পালন করেন। এই বাড়িকে এলাকার লোকজন মীরের বাড়ি হিসেবেই জানে। বনেদি পরিবার হিসেবে জায়গা-জমি আর প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিল বেশি।

গোলাম মাওলার প্রতিবেশী শাহেদ হোসেন বলেন, ‘কেন দীর্ঘদিন যাবৎ এ ছেলেটা জেলে থাকে? তার অনেক সম্পদও আছে, গোলাম মাওলা সাবে লিখখা দিয়া গেছে। আমার মনে হয়, কোনো প্রভাবশালী তার পেছনে জড়িত আছে। গোলাম মাওলার সম্পদ যাতে তারা আত্মসাৎ করি খায়।’

কথার সূত্র ধরে ফজলু মিয়ার চাচাতো ভাই সৈয়দ বাদল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁর কাছে ফজলু মিয়া কোথায়—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একবার শুনছিলাম জেলে আছে, এর পর আর বলতে পারি না কোন জায়গায় আছে।’ তিনি বলেন, ‘মামলা হইছিল, আমি মারছিলাম, এইটা নিয়া মামলা হইছিল। সৈয়দ গোলাম মাওলা বাদী হইয়া মামলা, কেইস করছিলেন ।’

আটকের সময় তরুণ ফজলু এখন ঠিকমতো হাঁটতেও পারেন না, বয়সের কারণে কথাও জড়িয়ে যায় তাঁর। কী কারণে তাঁকে কারাগারে আসতে হয়েছে, বিষয়টি পরিষ্কার মনে করতে না পারলেও ফজলু জানান, তাঁকে মেরে চেক বই নিয়ে যায় উকিল হারুন। তাঁর বাবার জমি বিক্রির পাঁচ লাখ ৮০ হাজার টাকাও নিয়ে গেছে তারা।

ফজলুর কথার সূত্র ধরে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন হারুনের বাড়িতে যাওয়া হয়। তিনি সিলেট আদালতের আইনজীবী ছিলেন। ২০০৪ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। এর পর কথা হয় তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে। তাঁরা অভিযোগের আঙুল তোলেন অন্য এক চাচা ও চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে।

ফজলুর অভিযোগের কথা জানালে তাঁর চাচি আবেদা খাতুন বলেন, ‘ফজলু বলছে? এগুলো ডাহা মিথ্যা।’

এর পর তাঁদের ছেলে ও ফজলুর চাচাতো ভাই সৈয়দ জাবির আনোয়ার সুমিত বলেন, ‘সেলিম ভাই জড়িত, মর্তুজা আলীও জড়িত। জায়েদ, লোকমান, আমার এক আমেরিকান চাচা আছুইন, তাইন জড়িত। এই জায়েদ সাবও জড়িত, খোকন চাচাও জড়িত। ডুবাইত থাকুইন যে তাইনও জড়িত, সব জড়িত।’

তাঁদের কথার সূত্র ধরে আলাপ হয় অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোর্তজা আলী সেলিমের সঙ্গে। তিনি দাবি করলেন, সবকিছুই জানেন ডা. সৈয়দ লোকমান আলী। তবে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি মোর্তজা আলী।

এর পর মোবাইল ফোনে ডা. সৈয়দ লোকমান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, মোর্তজা মিথ্যা বলছেন। তবে তিনিও ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি।

সন্দেহভাজন থেকে পাগল বানানো পর্যন্ত যাঁরাই জড়িত, তাঁদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানালেন মানবাধিকারকর্মীরা।

এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘ফজলু মিয়াকে একটা সুষ্ঠু জীবনযাপনে বাধাগ্রস্ত করছে। সেটা যদি চিহ্নিত হয়ে থাকে, তাহলে তো আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরই তো ধরার কথা, ফজলু মিয়াকে আটকে রাখার কথা নয়।’

একই সঙ্গে ফজলুর অন্ধকার জীবনের অবসান ঘটানোর দাবি জানান সুলতানা কামাল।