লিফট ও জেনারেটর নেই, ঠিকাদার উধাও
নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সাড়ে চার বছর পর গণপূর্ত বিভাগের কাছ থেকে ফেনী সদর হাসপাতালের নতুন ভবন বুঝে পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। নতুন ভবনে লিফট স্থাপন করা হয়নি, জেনারেটরও চালু হয়নি। গণপূর্ত বিভাগ দাবি করছে, চার বছর আগেই লিফট ও জেনারেটরের জন্য প্রায় ৫৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের। এখন তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফেনী সদর হাসপাতালকে ১৫০ থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার পর ১৫০ শয্যার জন্য প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে চারতলা নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সাড়ে চার বছর পর বিভিন্ন টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন ভবন স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ফেনীর তৎকালীন সিভিল সার্জন ও ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. ইউসুফ ও হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) অসীম কুমার সাহা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে গণপূর্ত বিভাগের কাছ থেকে নতুন ভবনটি বুঝে নেন।
নতুন ভবন হস্তান্তর ও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পাঁচ মাস পর নিয়োগ পাওয়া হাসপাতালের দুই কর্মকর্তা তত্ত্বাবধায়ক সারওয়ার জাহান ও সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পান, নতুন ভবনের লিফট ও জেনারেটর চালু নেই। প্রায় ২৫টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রে (এসি) মরিচা পড়েছে।
এ নিয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক গণপূর্ত বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানালে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুর রহমান ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বিষয়টি জানতে পারেন। নিজ কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা জানতে পারেন, বিল পরিশাধ হয়েছে, অথচ লিফট ও জেনারেটর চালু হয়নি।
গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, একটি লিফটের জন্য ৩৮ লাখ টাকার মধ্যে ২৮ লাখ টাকা এবং ২০০ কেভির একটি জেনারেটর বাবদ ৩০ লাখ টাকা চার বছর আগেই পরিশোধ করা হয়েছে দুই ঠিকাদারকে। কিন্তু লিফট ও জেনারেটর আজও চালু হয়নি।
লিফট চালু না হওয়ায় পুরোনো ভবনের অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে আনা রোগী নতুন ভবনের কেবিন ও ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে এবং মুমূর্ষু রোগী, চিকিৎসক ও নার্সদের চারতলায় উঠতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। একইভাবে জেনারেটর চালু না থাকায় বিদ্যুৎ চলে গেলে নতুন ভবন ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়। এ ছাড়া ডাস্টবিনের রাস্তা প্রয়োজন অনুযায়ী না করায় ডাস্টবিন থেকে পৌরসভার ময়লার গাড়ি বর্জ্য অপসারণ করতে পারছে না বলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সারওয়ার জাহান জানান।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের উপস্থিতিতে গত মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আফসার আলী ও সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, তত্ত্বাবধায়কের চিঠির আগে তাঁরা জানতেন না, নতুন ভবনে লিফট আছে কি না। পরে লিফট চালু করার জন্য ঠিকাদারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং জেনারেটর চালুর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তবে দীর্ঘ বছর ধরে জ্বালানি তেল না থাকায় জেনারেটরটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ওই দুই প্রকৌশলী।
গণপূর্ত বিভাগের ফেনী জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুর রহমান জানান, চার বছর আগে লিফটের ৩৮ লাখ টাকার মধ্যে ২৮ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এ টাকা তাঁর ফেনীতে যোগদানের আগেই পূর্বসূরি নির্বাহী প্রকৌশলী পরিশোধ করেছেন বিধায় বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। বিষয়টি জানার পর আট মাস ধরে ঠিকাদারকে চিঠি দেওয়া হলেও ঠিকাদার বিভিন্ন টালবাহানা করে যোগাযোগ করছেন না বা ফেনী আসছেন না।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সারওয়ার জাহান বলেন, ‘লিফটসহ নতুন ভবনের ত্রুটি নিয়ে এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
নতুন ভবনে আইসিইউ এবং সিসিইউর জন্য কক্ষ বানানো হলেও সিসিইউ কক্ষের সেন্ট্রাল অক্সিজেন, রোগীর শয্যা বসানো হয়নি। এ ছাড়া দক্ষ জনবল নিয়োগ না করায় জীবন রক্ষাকারী অতি গুরুত্বপূর্ণ এ কক্ষগুলো চালু করা যাচ্ছে না। যন্ত্রপাতিসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে যদি দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া না হয়, তা যেমন মানুষের সেবা দেওয়ার কাজে আসবে না, তেমনি দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে যন্ত্রপাতিসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ না হলে তাও মানুষের কাজে আসবে না।
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুর রহমান জানান, ২০০৪ সালে বাংলাদেশে পাঁচটি ২৫০ শয্যার হাসপাতালের নকশায় সিসিইউ ও আইসিইউ স্থাপন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফেনী সদর হাসপাতালের নতুন ভবনের সিসিইউতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাগানোর কথা দরপত্রে ছিল না। ফেনী সদর হাসপাতালের নতুন ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। ২০১০ সালে ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয় এবং ঠিকাদারকে ১০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা টাকা পরিশোধ করা হয়। ইমারত নির্মাণ দরপত্রের বাইরে লিফটের জন্য ৩৮ লাখ টাকার এবং জেনারেটর স্থাপনের জন্য ৩০ লাখ টাকার আলাদা ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। এ দুই ঠিকাদার কাজ শেষ না করেই অর্ধকোটি টাকা বিল নিয়ে যান। বিল পরিশোধের পর থেকে ঠিকাদার গণপূর্ত বিভাগের হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়। ঠিকাদারকে বারবার চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কর্মকর্তারা ব্যর্থ হয়ে আসছেন। ঠিকাদার পাঁচ ভাগ বাকি কাজ শেষ না করায় সাড়ে চার বছর নতুন ভবন হস্তান্তর প্রক্রিয়া ঝুলে থাকে। অবশেষে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সাড়ে চার বছর পর লিফট ও জেনারেটরের কাজ বাকি রেখেই চলতি সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নতুন ভবন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু হাসপাতালে ওয়ার্ড চালু করা হয় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনীর ছয় মাস পর।
এর আগে নতুন ভবন হস্তান্তর সম্পর্কে এনটিভি অনলাইনে সংবাদ প্রকাশের পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে এবং নতুন ভবন হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ফেনী ছাড়াও কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম, চট্টগ্রামের মিরসরাই, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, সেনবাগ, পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির রামগড়সহ আশপাশের এলাকার মানুষ প্রতিনিয়ত ফেনী সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বারইয়ার হাট থেকে চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের ফেনী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।