‘এই বোমা কোত্থেকে? কে তুমি খেলিছ বিশ্ব লয়ে?’
হোসেনী দালানে বোমা হামলার ঘটনায় দেশব্যাপী চলছে নিন্দার ঝড়। সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির ভয়ংকর চক্রান্তের আভাস দেখছে মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের উঠে আসা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সে ধরনের চিত্রই উঠে এসেছে। এ ঘটনাকে কোনোভাবেই সাধারণ সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে দেখছে না কেউ; বরং বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের আরেকটি ময়দান হিসেবে তৈরির নীলনকশা বাস্তবায়নের একটি ধাপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মনে করছে অনেকে।
শুক্রবার দিবাগত রাতে বোমা হামলার খবর গণমাধ্যমে উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকে শুরু হয় নিন্দার ঝড়। হোসেনী দালানের ৪০০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম শিয়াদের ওপর এমন হামলা দেখে হতবাক হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। এ পরিস্থিতি ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় অশনিসংকেত হিসেবে মনে করছে অনেকে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী শিয়াদের ওপর হামলার এ ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ফেসবুকে। তিনি স্ট্যাটাসের একটি অংশে লেখেন :
‘জীবনে কোনোদিন শুনি নাই বাংলাদেশে শিয়া-সুন্নি লইয়া কোনো হানাহানি-হিংসার চাষ আছে, অন্য যা কিছু লইয়াই থাকুক। আগামী ২০ বছরেও এই বিষয়ে সমাজের ভিতর হিংসার তেমন ভালো ফলনের সম্ভাবনা দেখি না।
তাহা হইলে এই বোমা নাজিল হইলো কোত্থেকে? কে তুমি খেলিছ বিশ্ব লয়ে?’
কবি ও গায়ক অরূপ রাহী ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, “চিন্তা করেন কেন? আপনার হইয়া দেশপ্রেমের সোল এজেন্টরা চিন্তা কইরা ঘাম ঝরায়া ফেলতেছে। ডোন্ট ওয়ারি। আপনের দেশপ্রেম কি তিনাদের থেকে বেশি? দেশে 'জঙ্গিবাদবিরোধী জিহাদ' চলতে হইলে কিছু 'জঙ্গি' তো থাকা লাগবে, নাকি? কিছু বোমা-টমা না ফাটলে কেমনে এই 'জিহাদ' হবে? কার বিরুদ্ধে?
তাই আপনেরা চেতনা, উন্নয়ন আর কম গণতন্ত্রে মশগুল থাকেন। 'সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদবিরোধী জিহাদ' উনারা চালায়ে যাবেন। অনন্তকাল।”
চলচ্চিত্র নির্মাতা মোহাম্মদ রোমেল মন্তব্য করেন, ‘বিদেশি নাগরিক হত্যা এবং তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার পর সিরিয়ার কথা মনে পড়ছে খুব! মনে হচ্ছে বাংলাদেশকে একটা যুদ্ধক্ষেত্র বানাতে গভীর তৎপরতা চলছে। এমন গুপ্ত এবং সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক হামলার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নাগরিকদের সতর্ক এবং ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়া ছাড়া আমাদের বাঁচার পথ বন্ধ হয়ে আসছে মনে হয়। সিনটম দেখে মনে হচ্ছে, ভয়াবহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গেমের ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নেওয়া হয়েছে।’
ইমরান এইচ সরকার লেখেন, “‘তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা হতে পারে' মর্মে কয়েক দিন আগে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। তার পরও এ হামলা হয়েছে এবং সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা স্পষ্ট।
আচ্ছা, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সরকারের কেউ কি পদত্যাগ করেছে কিংবা দায়িত্বে অবহেলার জন্য কি কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিএনপি-জামায়াত জড়িত। সরকারের এই তিনটি ড্রাফট কি বেশ সেকেলে নয়? একটা ঘটনার পর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে দায়ী করা যে একটা অপরাধ, এই বোধ-বিবেচনাটুকুও কি সরকার হারিয়ে ফেলেছে?
এই অসুস্থ রাজনীতি, বিচারহীনতা, ডিনায়াল সিনড্রোম আর দায়দায়িত্বহীন অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর অপসংস্কৃতি আমাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে! সিরিয়াসলি, সবকিছু খুব অসহ্য হয়ে যাচ্ছে! খুব অসহ্য!!”
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া লেখেন, ‘শিয়াদের প্রতি হামলা আমি মেনে নিচ্ছি না। আমি প্রতিবাদ জানাচ্ছি। জানাতে থাকব। সবকিছু মেনে নিতে নিতে আমাদের মেরুদণ্ডে জোর কমে যাচ্ছে। আপনি মেনে নেবেন কি না, সেটা আপনার মর্জি।’
সাংবাদিক শাহেদ আলম তাঁর স্ট্যাটাসের একটি অংশে লেখেন, “দেশটাকে পাকিস্তানি মডেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন, কোন অভিলাষে। আফসোস, সাম্প্রতিক ধর্মীয় কলঙ্কগুলো তিলকের মতোই বসে যাচ্ছে বর্তমান শাসকদের কপালে। সেটা গণতন্ত্রহীনতারই খেসারত। এই গণতন্ত্রহীনতার গন্তব্য বড়ই করুণ সবার জন্য।
এতদিনে এটাও দেখতে হলো যে এখানকার শিয়া সম্প্রদায়কে আঘাত করা হলো, পাকিস্তানের মতো? দেশটাকে পাকিস্তান/আফগানিস্তান বানানোর পেছনের মানুষগুলো আসলে কারা?”
বড় চক্রান্তের শঙ্কা প্রকাশ করে জিয়া হাসান নামের এক ফেসবুকার তাঁর দীর্ঘ স্ট্যাটাসের একটি অংশে উল্লেখ করেন, ‘ভয়েই লিখছি, আমি দেখতে পাচ্ছি, আর কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের টেমপ্লেট মতে, মসজিদ এবং পাবলিক প্লেসে বোমা পড়বে। তখন বলা হবে, শিয়াদের ওপর হামলার প্রতিশোধে সুন্নিদের ওপর এ হামলা হয়েছে। তারপর, শিয়াদের ওপর আরো বড়সড় হামলা হলেও অবাক হবো না, এই হামলাগুলোর পরে বিবিসি-সিএনএনে টাইটেল হবে, রিটালিয়েটরি অ্যাটাক বাই সুন্নি মেজরিটি অন, শিয়া মুসলিমস।
বিগত দিনের তাজিয়া মিছিলের ওপর হামলা অনেক বড় কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটার একটা পরিষ্কার প্যাটার্ন আছে। এটা একটা টেমপ্লেট ফলো করা হচ্ছে, যা আমরা বিভিন্ন দেশে দেখেছি।”
প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা ঘটনা বিশ্লেষণ করে তাঁর লেখার একটি অংশে উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশে শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে এমন কোনো বিভেদ বা এন্টাগনিজম নাই, যার ফলে সুন্নি সম্প্রদায়ের কেউ গিয়ে শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর ককটেল হামলা করবে। এটা রাজনৈতিকভাবে আয়োজিত ও সংগঠিত ঘটনা।’
আরিফুর রহমান সিদ্দিকী নামের একজন মন্তব্য করেছেন, “সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ ইস্যুতে বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে চলছে, আর কত দিন এভাবে জোড়াতালি দিয়ে চলবে? এভাবে জোড়াতালি দিয়ে চললে ‘বাংলা হবে আফগান’ খুব বেশি দেরি নেই বলে মনে হচ্ছে।”
বোমা হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত ফেসবুকে এ ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে মানুষ। এ হামলার বিচার দাবি করার পাশাপাশি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে মূল ঘটনা বের করার দাবিও জানান অনেকে।