‘যৌক্তিকভাবেই বলেছি, বিচার চাই না, শুভবুদ্ধির উদয় চাই’
প্রিয় সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। রক্তাক্ত দেহ দেখেও চোখের পানি ফেলতে পারেননি। সব শোক, যন্ত্রণা বুকে চেপে বলেছেন, ‘কোনো বিচার চাই না। আমি চাই, সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’
আজ রোববার দুপুরের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে ছেলের লাশ নিয়ে আগের কথারই প্রতিধ্বনি করলেন। বললেন, ‘কালকে আমি যে কথা বলেছি, সেটা যৌক্তিকভাবে বলেছি, সেটা কোনো আবেগ বা উত্তেজনার কথা নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে ফয়সল আরেফিন দীপন শনিবার দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত হয়েছেন। তিনি নিহত লেখক অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতির কর্ণধার ছিলেন।
ছেলের লাশ নেওয়ার পর অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘যদি শুভবুদ্ধি উদয় হয়, তাহলেই সমস্যার সমাধান হবে। বিচার, পুলিশ ও আইন-আদালত দিয়ে তো শুধু আমরা একজনকে শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু জাতীয় উন্নতি হবে না।’urgentPhoto
প্রবীণ এই শিক্ষক জানান, নিয়ম অনুযায়ী একটি মামলা তিনি করবেন। কারণ হিসেবে বললেন, ‘আমি আইন মেনে চলি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অথরিটি (কর্তৃপক্ষ) বলেছে একটি দরখাস্ত দিতে। আমি আজকে দেব। আজকে না পারলে আগামীকাল দেব। তার মানে এই নয় যে আমি এর ওপর নির্ভর করি। আমি শুভবুদ্ধির জাগরণ চাই, সমাজে, রাজনীতিতে, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে।’
ব্লগার হত্যার সম্প্রতিক ঘটনাগুলোর বিচার সম্পর্কে আবুল কাসেম বলেন, ‘ঘটনা ঘটছে। এর জন্য সরকার চেষ্টা করছে রীতি অনুযায়ী পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আদর্শগতভাবে, রাজনৈতিকভাবে আগে সমাধান করতে হবে। সেই সঙ্গে নিতে হবে আইনগত ব্যবস্থা। যদি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা না যায়, শুধু আইনগত ব্যবস্থা দিয়ে এটি সমাধান করা যাবে না। এই ঘটনা আজ ভারত ও পাকিস্তানে ঘটছে, মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে তো আছেই। তাই এটিকে রাজনৈতিকভাবে, আদর্শগতভাবে গভীরভাবে দেখা উচিত।’
এসব ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক বলেন, ‘এগুলো তো পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে। ব্যাপারটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক রূপ নিয়ে আছে। আজকে মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে বিদেশি সৈন্য, আমেরিকান সৈন্য, ব্রিটিশ সৈন্য, ন্যাটো বাহিনী, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী আছে তারই প্রতিক্রিয়ায় সেখানে দেখা দিয়েছে আল-কায়েদা, তালেবান, আইএস। শুধু ধর্মের কারণে করা হচ্ছে মনে হয় না। এখানে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কারণ কাজ করছে। আমার দেশের সরকারকে হত্যা করছে। আমরা আমাদের সরকারকে নিজেরা পরিবর্তন করতে চাই। এ রকম একটি জাতীয়তাবাদী মনোভাব আইএস, আল-কায়েদা, তালেবান সবারই আছে। তবে সাংস্কৃতিকভাবে তারা এখনো ধর্মের পর্যায়ে আছে। সেজন্য ধর্মকে ধরে এবং পাশ্চাত্য গণমাধ্যম তাদের ধর্মের ব্যাপারটিকেই অনেক বড় করে দেখায়, অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারগুলোকে একেবারে দেখায় না।’
গতকাল কয়টার দিকে দীপন নিহত হয়েছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল কাসেম বলেন, ‘দীপন কয়টার সময় নিহত হয়েছে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। ঘটনার পরম্পরায় আমার অনুমান, দুপুর ৩টার দিকে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি তাকে দেখতে পেয়েছি সন্ধ্যা ৬টার সময় গিয়ে। এতক্ষণ প্রায় তিন ঘণ্টা, হয়তো কমও হতে পারে ঘরে বন্দি অবস্থায় ছিল। আমি দুবার গিয়েছি সেখানে। আমি অনুমান করতে পারি নাই, স্বপ্নেও ভাবতে পারি নাই, এ রকম ঘটনা ঘটেছে ভেতরে। পরে মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট তিনি চাবি জোগাড় করে খুললেন। আমি এবং ওই প্রেসিডেন্ট সাহেব একই সময় ঘরে ঢুকেছি। ঢুকে দেখেছি। তখন পুলিশ দেরি করেনি। খুব দ্রুতই এসেছে। এসে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেছে। আমাদের চাবি দিয়েই খুলেছে। একজন কমপোজিটর ছিল সে আসে নাই। তার কাছ থেকে এনে খুলেছেন।’
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনী সংস্থার কার্যালয়ে ঢুকে দুর্বৃত্তরা নৃশংসভাবে হত্যা করে এই প্রকাশনীর কর্ণধার দীপনকে। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।