রাজবন বিহারে কঠিন চীবরদান উৎসব শুরু

Looks like you've blocked notifications!
রাঙামাটির রাজবন বিহারে দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব উপলক্ষে চরকায় সুতা কাটার উদ্বোধন করেন রানি ইয়ান ইয়ান। ছবি : এনটিভি

পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা দেশের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ মন্দির রাঙামাটির রাজবন বিহারে আজ বৃহস্পতিবার থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুইদিনব্যাপী দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব শুরু হয়েছে।

৪২তম কঠিন চীবর দানোৎসবের প্রথম দিনে বিকেলে রাজবন বিহারের পাশে স্থাপিত বেইন ঘরে পূণ্যবতী উপাসিকা বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চরকা সূতা কাটা থেকে কাপড় তৈরির জন্য বেইন ঘর উদ্বোধন করেন চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, চরকায় সুতা কাটা উদ্বোধন করেন চাকমা রানি ইয়ান ইয়ান।

এর আগে বেইন ঘরে আগত পূর্ণার্থীদের পঞ্চশীল দেন রাঙামাটি রাজবন বিহারের প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সহসভাপতি গৌতম দেওয়ান।

এ উৎসবকে ঘিরে রাঙামাটি শহর উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। আগামীকাল শুক্রবার তৈরি চীবর ধর্মীয় অনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ভিক্ষু সংঘের উদ্দেশে দান করা হবে। 

এ সময় চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, ‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সুতা কেটে বেইন বুনে ভিক্ষু সংঘকে দান করা হয়। বিশাখা প্রবর্তিত আড়াই হাজার বছরের পুরনো জুম এবং বয়নের যে ঐতিহ্য আছে সেটাকে আমরা সমাদর করছি।’

আগামীকাল শুক্রবার সকাল ৬টায় বুদ্ধ পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু হবে। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে দেব-মানবের তথা সব প্রাণীর হিতার্থে ধর্মদেশনা। ধর্মদেশনায় উপস্থিত থাকবেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির। 

দুপুর ১টায় শোভাযাত্রা সহকারে কঠিন চীবর ও কল্পতরু মঞ্চে আনয়ন হবে। পঞ্চশীল গ্রহণের পর দুপুর আড়াইটায় বনভন্তের মানব প্রতিকৃতির উদ্দেশ্যে কঠিন চীবর উৎসর্গ হবে। এ সময় বনভান্তের প্রতিনিধি হিসেবে এ চীবর গ্রহণ করবেন আবাসিক প্রতিনিধি শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণভাবে রাঙামাটি রাজবন বিহারে প্রতিবছর এ দানোৎসবের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালনের জন্য এরই মধ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের সঙ্গেও এ নিয়ে উপাসক-উপাসিকা পরিষদের কয়েক দফা বৈঠকের পর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সহসভাপতি গৌতম দেওয়ান জানান, এ বছর ৪২তম দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আশা করব, বরবারের মতো এবারও সুষ্ঠুভাবে দান অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারব। 

পাহাড়ি নারী তুনা চাকমা বলেন, বুদ্ধ নারী বিশাখা আড়াই হাজার বছর আগে যেভাবে জুম থেকে তুলা নিয়ে এসে এবং তুলা থেকে সুতা তৈরি করে কঠিন চীবর বানিয়েছেন সেভাবে আমরাও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চীবর (বস্ত্র) তৈরি করে ভিক্ষু সংঘকে দান করব। এবার ১৬৫টি বেইন ঘরে ৬৬০ জন পাহাড়ি নারী ২৪ ঘণ্টায় তৈরি করবে এ চীবর। 

এ ছাড়া সুতা সিদ্ধ, রঙ, টিয়ানো, শুকানো, তুম করা, নলী করা, বেইন টানার কাজে আরো শতাধিক পুরুষ কর্মী অংশগ্রহণ করছেন। পরের দিন সকাল ৬টা থেকে শুরু করে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চীবর সেলাই চলবে।

এদিকে উৎসব উপলক্ষে রাজবন বিহার এলাকায় বিশাল মেলা বসেছে। মেলা প্রাঙ্গণে সহস্রাধিক স্টলে সারা দেশ থেকে কুটির ও হস্তশিল্পের পণ্যের পসরা নিয়ে লোকজন অংশ নিয়েছে।

আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভগবান গৌতম বুদ্ধের উপাসক বিশাখা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা কেটে বৌদ্ধ পুরোহিতদের ব্যবহার্য চীবর (বস্ত্র) তৈরি করে দানকার্য সম্পাদন করার পদ্ধতিতে এ কঠিন চীবর দান প্রবর্তন করেন। প্রত্যেক বছর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্ষাবাস শেষে আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা এই মহাপুণ্যানুষ্ঠান কঠিন চীবর দানোৎসব পালন করে। 

প্রতি বছরের মতো এ বছরও কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে ভক্ত অনুরাগীরা অংশ নিচ্ছেন। রাজবন বিহারে ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দান প্রচলন করা হয়। এর আগে রাঙামাটি জেলার তিনটিলা বৌদ্ধ বিহারে ১৯৭৩ সালে এই কঠিন চীবর দান করা হয়। 

এদিকে রাজবন বিহারে দুইদিনব্যাপী কঠিন চীবর দান উপলক্ষে পুলিশ বিভাগ থেকে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। 

এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদ উল্লাহ বলেন, কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য ব্যাপকভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। রাজবনবিহারের কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানের জন্য ৫০০ জন পুলিশ, সাদা পোশাকধারী পুলিশ, পুলিশ কন্ট্রোল রুম রয়েছে। এদিকে রাজবনবিহারের নিজস্ব  স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও নিয়োজিত আছেন।