বান্দরবানে ঐতিহ্যবাহী রাজপুণ্যাহ উৎসব শুরু
নেই রাজসিংহাসন প্রসাদ। তবে রয়েছে রাজকীয় আচার অনুষ্ঠান ও রীতি-রেওয়াজ। বান্দরবান বোমাং রাজপরিবার এখনো ধরে রেখেছে রাজকীয় ঐতিহ্য। এখনো প্রজারা রাজা বাহাদুরকে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম করে। প্রতিবছর প্রজাদের কাছ থেকে জুমের বার্ষিক খাজনা আদায়ের জন্য আয়োজন করা হয় শতবছরের ঐতিহ্যবাহী রাজপুণ্যাহ (পইংজ্রা) উৎসব।
আজ শুক্রবার বেলা ১১টায় স্থানীয় রাজারমাঠে ১৩৮তম রাজপুণ্যাহ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় পোশাক পরিধান করে রাজবাড়ী থেকে রাজকীয় বাঁশির সুরে অনুষ্ঠানস্থলে নেমে আসেন বান্দরবান বোমাং সার্কেল চিফ ১৭তম রাজা ইঞ্জিনিয়ার উচপ্রু চৌধুরী। এ সময় তাঁর সৈন্য-সামন্ত, উজির-নাজির, সিপাহশালাররা রাজাবাহাদুরকে গার্ড দিয়ে মঞ্চস্থলে নিয়ে যান।
বোমাং রাজা সিংহাসনে উপবিষ্ট হলে সারিবদ্ধভাবে বান্দরবান জেলার সাতটি উপজেলার ৯৫টি মৌজা এবং রাঙ্গামাটির কাপ্তাই ও রাজস্থলী উপজেলার ১৪টি মৌজাসহ মোট ১০৯টি মৌজার হেডম্যান, আট শতাধিকেরও বেশি কারবারি, রোয়াজারা রাজাকে কুর্নিশ করে জুমের বার্ষিক খাজনা ও উপঢৌকন রাজার হাতে তুলে দেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বেসমারিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, বিশেষ অতিথি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপি, সেনাবাহিনীর ৬৯ রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নকীব আহমেদ চৌধুরী, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা, জেলা প্রশাসক মিজানুল হক চৌধুরী, জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানসহ সামরিক-বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, পার্বত্যাঞ্চলের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ভূমি বিরোধ। ভূমি জটিলতা নিরসনে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে পাহাড়ের সংকট নিরসন করা হবে। পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়নে আন্তরিকতার কমতি নেই সরকারের। সব সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে।
বিশেষ অতিথি পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর বলেছেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক সরকার। পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এরই মধ্যে চুক্তির মৌলিক অনেকগুলো দিক বাস্তবায়িত হয়েছে। অবাস্তবায়িত ধারাগুলোও আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
বোমাং রাজা ইঞ্জিনিয়ার উচপ্রু চৌধুরী বলেছেন, ‘অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বোমাং সার্কেলকে লাভজনক এবং অনুন্নত জায়গাটি উন্নত করে তুলতে চাই। জুমের খাজনা বিগত দেড় শ বছরেও বাড়েনি, আগের মতোই কর আজও ছয় টাকায় রয়ে গেছে। ভূমি কর বাড়ানো সরকারের ওপর নির্ভর করে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভূমি কর বাড়ানো দরকার। আদায় করা ভূমি কর থেকে আনুপাতিক হারে রাজা, হেডম্যান এবং কারবারীরা যত টাকা পায়, তা খুবই অপ্রতুল। এটি কম হলেও আরো দশগুণ বাড়াতে হবে। না হলে বর্তমান বাজারের আর্থিক ব্যয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।’
বোমাং রাজা আরো বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়নে কাজ করতে চাই। স্থানীয়ভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মৌজা, হেডম্যান ও কারবারীদের সম্পৃক্ত করার দাবি জানাচ্ছি। যেহেতু গ্রামের প্রধান কারবারী এবং মৌজাপ্রধান হেডম্যান, তাঁরাই সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করেন।’
বোমাং রাজপরিবার জানায়, ১৮৭৫ সালে পঞ্চম বোমাং রাজা সাক হ্ন ঞোর আমল থেকে বংশপরস্পরায় ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী রাজপুণ্যাহ উৎসব হয়ে আসছে। রাজপুণ্যাহ মেলায় বসেছে নাগরদোলা, সার্কাস, বিচিত্রানুষ্ঠানু, পুতুল নাচ, মৃত্যুকূপসহ ব্যতিক্রমী নানা আয়োজন। এ ছাড়া হরেক রকম জিনিসপত্রের দোকান এবং সারা রাতব্যাপী চলবে যাত্রা অনুষ্ঠান।
রাজপুণ্যাহ উৎসব পরিণত হয়েছে পাহাড়ি-বাঙালির মিলনমেলায়। শুধু বান্দরবান, রাঙামাটি নয় রাজপুণ্যাহ মেলা দেখতে ভিড় জমিয়েছেন দেশি-বিদেশি হাজারো পর্যটক।